শ্যামপুর গ্রামটা যেন একটা ছবির মতো সুন্দর। চারদিকে সবুজ খেত, নদীর কুলকুল শব্দ আর পাখির মিষ্টি ডাকে সবসময় মুখরিত। সেই গ্রামে বাস করত দুই ভাই – রমজান আর রহমান। রমজান ছিল জোয়ান আর তেজী, আর রহমান ছিল শান্ত আর ঠান্ডা মাথার মানুষ। দুই ভাইয়ের মধ্যে এত ভালোবাসা ছিল, যেন একই গাছের দুটো ডাল।
একদিন, ফাল্গুন মাসের শেষ দিকে, যখন গাঁয়ের পথে ঘাটে পলাশের আগুন লেগেছে, রমজান গ্রামের হাটে গিয়েছিল কিছু দরকারি জিনিস কিনতে। হাট থেকে ফেরার পথে, গ্রামের মাতব্বর রহিমুদ্দিনের ছেলে কাদেরের সাথে তার দেখা। কাদের ছিল খুব অহংকারী আর বদমেজাজি। আগে থেকেই রমজানের সহজ সরল স্বভাব আর সবার কাছে তার ভালোবাসাকে সে সহ্য করতে পারত না।
কাদের পথ আটকে দাঁড়াল, বলল, “কিরে রমজান, আজকাল তো খুব উড়ছিস দেখছি! আমার বাবার জমিতে যেন আর তোর ছায়া না পড়ে।”
রমজান শান্তভাবে বলল, “কাদের ভাই, আমি তো কখনও তোমাদের জমির আশেপাশেও যাইনি।”
কাদেরের মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। সে যা নয় তাই রমজানকে গালাগালি করতে লাগল। রমজান আর নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রতিবাদ করলে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ করে, রমজানের হাতে থাকা বাঁশের লাঠি ভুল করে কাদেরের মাথায় লাগলে সে মাটিতে পড়ে গেল।
গ্রামের লোকজন ছুটে এল। রহমতুল্লাহ মাতব্বর ছেলের এই অবস্থা দেখে রাগে ফেটে পড়লেন আর রমজানকে ধরতে হুকুম দিলেন। রমজান হতভম্ব হয়ে গেল। তার মনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না।
রহমতুল্লাহ মাতব্বরের বাড়িতে বিচার বসল। গ্রামের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা সেখানে উপস্থিত হলেন। রহমতুল্লাহ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “যে আমার ছেলেকে মেরেছে, তার উচিত শাস্তি হওয়া দরকার।”
অনেকে রমজানের হয়ে কথা বলল, বলল রমজানের কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু মাতব্বরের রাগের সামনে কারও কথা টিকল না। মাতব্বর রায় দিলেন, রমজানকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।
রমজান ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফিরল। ছোট ভাই রহমানের কাছে সব ঘটনা খুলে বলল। রহমান বড় ভাইয়ের কষ্টে খুব দুঃখ পেল, কিন্তু সে জানত মাতব্বরের কথার ওপর কথা বলার সাহস কারও নেই।
পরের দিন রমজান গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। তার চোখে জল আর বুকে চাপা কষ্ট। রহমান নীরবে বড় ভাইয়ের বিদায় দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সময় বয়ে চলল। গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঝড়। শ্যামপুর গ্রামও সেই ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে পারল না। একদিন, পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে ঢুকে লুটপাট আর আগুন লাগানো শুরু করল। গ্রামের বহু মানুষ ঘরছাড়া হল, অনেকে প্রাণ হারাল।
রহমান তখন যুবক। সে গ্রামের ছেলেদের নিয়ে একটা প্রতিরোধ দল তৈরি করল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের গ্রামকে বাঁচানো। একদিন, সামনাসামনি যুদ্ধে রহমান গুরুতর আহত হল। তার পায়ে গুলি লেগে রক্ত ঝরতে লাগল। সঙ্গীরা তাকে ধরে একটা জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।
জ্ঞান ফিরলে রহমান দেখল, তার পাশে একজন অচেনা লোক বসে আছে। লোকটার মুখ শুকনো, চোখে গভীর দুঃখ। রহমান ভালো করে চিনতে না পারলেও লোকটার গলা যেন তার চেনা মনে হল।
লোকটি ধীরে ধীরে বলল, “রহমান, তুই কি আমাকে চিনতে পারছিস?”
রহমান ভালো করে তাকিয়ে দেখল। আরে, এ তো তার বড় ভাই রমজান! অনেক দিন পর দুই ভাইয়ের দেখা হল। রমজানের চোখে জল, রহমানের মুখে অবাক হওয়ার ছাপ।
রমজান বলল, “ভাই, আমি শুনেছিলাম গ্রামে যুদ্ধ লেগেছে। থাকতে না পেরে ছুটে এসেছি। তোকে এই অবস্থায় দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।”
রহমান দুর্বল গলায় বলল, “ভাই, তুমি এখানে? মাতব্বরের ভয়ে তো তুমি গ্রাম ছেড়েছিলে।”
রমজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তখন প্রাণের ভয়ে চলে গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু দেশের ডাক উপেক্ষা করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিয়েছিলাম। আজ শুনলাম আমাদের গ্রামে বিপদ, তাই না এসে পারলাম না।”
রমজান নিজের গায়ের চাদর ছিঁড়ে রহমানের পায়ের ক্ষত বাঁধল। তারপর বলল, “তুই এখানেই বিশ্রাম কর। আমি দেখছি আশেপাশে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় কিনা।”
রমজান জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে আহত আরও কয়েকজন গ্রামবাসীর সন্ধান পেল। তাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে সে সেবা করতে লাগল।
কয়েক দিন পর, মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের হটাতে সক্ষম হল। গ্রামে শান্তি ফিরে এল। রমজান আর রহমান আবার এক হল।
একদিন, গ্রামের সকলে মিলে যারা যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের সাহায্য করছিল। সেই সময় রমজানের চোখে পড়ল রহমতুল্লাহ মাতব্বরকে। মাতব্বরের বাড়িঘর পুড়ে গেছে, তিনি পথের ধারে অসহায়ভাবে বসে আছেন।
রমজান এগিয়ে গিয়ে মাতব্বরের কাছে দাঁড়াল। মাতব্বর রমজানকে দেখে প্রথমে চমকালেন, তারপর মুখ নিচু করে নিলেন।
রমজান শান্ত স্বরে বলল, “মাতব্বর সাহেব, আপনার কি কোনো সাহায্যের দরকার?”
রহমতুল্লাহ চোখের জলে রমজানের দিকে তাকালেন। তার গলা ধরে এল। তিনি কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।
রমজান বলল, “আমাদের গ্রামে এই দুর্যোগে আমরা সকলে এক। আসুন, আমরা সকলে মিলে আবার আমাদের গ্রামকে গড়ে তুলি।”
রমজান মাতব্বরের হাত ধরে তুললেন এবং তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। রহমানও বড় ভাইয়ের এই মহানুভবতা দেখে অবাক হল।
কয়েক দিন রমজানের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার পর রহমতুল্লাহ ধীরে ধীরে সুস্থ হলেন। একদিন তিনি রমজান আর রহমানের কাছে এসে হাত জোড় করে বললেন, “বাবা, তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। সেদিন রাগের বশে আমি তোমাদের প্রতি অবিচার করেছিলাম।”
রমজান হেসে বলল, “মাতব্বর সাহেব, সেই দিনের কথা আর মনে রেখে কাজ নেই। বিপদের দিনে আমরা সকলে এক হয়েছি, এটাই বড় কথা।”
রহমানও ভাইয়ের কথায় সায় দিল। মাতব্বরের মনে শান্তি ফিরে এল। তিনি বুঝতে পারলেন, ক্ষমা আর ভালোবাসাই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। রমজানের খাঁটি ভালোবাসা ও ক্ষমা শুধু তার জীবনকেই সুন্দর করেনি, বরং সমগ্র গ্রামের মানুষের মধ্যে এক নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭১ সালের সেই কঠিন সময়ে, রমজান দেখিয়েছিল যে ব্যক্তিগত বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।
~@বিপুল….