আশিয়ানার বারান্দায় বসে সূর্যাস্তের শেষ আভা দেখছিলেন তরিকুল ইসলাম সাহেব। লালচে আকাশটা ধীরে ধীরে ধূসর হচ্ছে, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছে দিনের সব কোলাহল। তার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ। এই বয়সটা সত্যিই অদ্ভুত। একদিকে কর্মজীবনের মধ্যগগনে তিনি, সাফল্যের হাতছানি। অন্যদিকে, জীবনের এক নতুন অধ্যায় যেন শুরু হচ্ছে, যেখানে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো আরও স্পষ্ট, আর সামনের পথটা যেন কুয়াশায় ঢাকা।
তাঁর চোখ চলে গেল ঘরের ভেতরের সোফায় বসা বাবা-মায়ের দিকে। বাবা, মিনহাজুল ইসলাম, শান্তভাবে খবরের কাগজ পড়ছেন। চুল প্রায় সব সাদা, চামড়ায় বয়সের ভাঁজ। মা, সবিলা বেগম, টিভি দেখছেন বটে, কিন্তু মাঝে মাঝেই তাঁর চোখ বুজে আসছে। একসময় যে বাবা-মা ছিলেন তাঁর কাছে বটগাছের মতো আশ্রয়, আজ তাঁদের দিকে তাকালে তরিকুল ইসলাম সাহেবের মনে এক অজানা ভয় এসে ভিড় করে।
মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। পরীক্ষার ফলাফলের দিন বাবা-মায়ের সে কী উচ্ছ্বাস! “আমাদের খোকা একদিন অনেক বড় হবে,” মা বলতেন পাড়া-প্রতিবেশীদের। বাবা মুচকি হাসতেন আর তরিকুল ইসলামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। তাঁদের চোখে ছিল অফুরন্ত স্বপ্ন আর ভালোবাসা। তিনি তখন ভাবতেন, বাবা-মা বুঝি চিরকাল এমনটাই থাকবেন।
কিন্তু সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। গত বছর বাবা দু’বার পড়ে গিয়েছিলেন। মা ইদানীং কথায় কথায় ভুলে যান। তরিকুল ইসলাম আর তাঁর স্ত্রী, নুরজাহান বেগম, এখন তাঁদের জন্য আরও বেশি সময় দেন। ডাক্তার দেখানো, ওষুধপত্র আনা, খাওয়াদাওয়া – সবকিছুর দিকেই কড়া নজর রাখতে হয়।
আজ সকালে মা হঠাৎ করেই তাঁর পুরোনো দিনের শাড়িগুলোর কথা বলছিলেন। “জানিস তরু, তোর বাবার সাথে যখন প্রথম দেখা হয়েছিল, এই লাল শাড়িটাই পরেছিলাম। তোর বাবা বলেছিলেন, আমাকে নাকি খুব মানিয়েছিল।” মায়ের চোখে তখন এক অন্যরকম ঔজ্জ্বল্য। তরিকুল ইসলাম সাহেব মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। এই স্মৃতিগুলোই যেন তাঁদের অক্সিজেন।
তিনি বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। পশ্চিম আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। জীবনটা একটা বৃত্তের মতো। একসময় বাবা-মা তাঁকে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন, কথা বলতে শিখিয়েছেন, স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। আজ সেই ভূমিকাটা যেন উল্টে গেছে। এখন তিনিই বাবা-মায়ের হাত ধরে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। এই পরিবর্তনটা মেনে নেওয়া কঠিন, কিন্তু এটাই বাস্তব।
হঠাৎই মা ডাকলেন, “তরু, ভেতরে আয়। চা খাবি?”
তরিকুল ইসলাম হাসলেন। হ্যাঁ, ভয় আছে, উদ্বেগ আছে। কিন্তু তার সাথে আছে গভীর ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ। বাবা-মা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। তাঁদের যত্নে রাখা, তাঁদের মুখে হাসি ফোটানো – এটাই এখন তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ। এই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ এর দশকে এসে তিনি বুঝতে পারছেন, জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়তো এটাই – বাবা-মায়ের পাশে থাকা, তাঁদের শেষ দিনগুলো আনন্দময় করে তোলা। এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা এই সম্পর্ক, যা হয়তো সবচেয়ে বেশি অনুভব করা যায় জীবনের এই অদ্ভুত সময়ে।
জীবনের এই বিশেষ সময়টা কি আপনার কাছেও এমনই মনে হয়?
~@বিপুল….