গল্প: নীলকণ্ঠী ।
লেখক: কাজী খলিলুর রহমান 
তারিখঃ- ২৮/০৬/২৪ ইং
প্রতি দিনের ন্যায় সেদিন ও গিয়েছিলাম বাজার শওদা করতে হঠাৎ কি হলো জানি না একটা অপরিচিত কন্ঠ বারবার ডেকে যাচ্ছে, এই শোনেন না ভাই! হতচকিত হয়ে তাকাতেই দৃষ্টি গোচর হয় এক মধ্য বয়সী নারী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আর বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গিমা করে ডাকছে, তাঁরই পাশ কাটিয়ে হনহন করে হেঁটে যেতে দেখি অজানা অচেনা অসংখ্য মানুষের তারা মেয়েলি গন্ধ উপেক্ষা করে যে যার গন্তব্যে, আর সকলে শুনছে তার ডাকাডাকি কিন্তু কেউ তাঁর ডাকে বা আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না আমি দূরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে অবলোকন করতে থাকি তার ক্রিয়া কলাপের। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে দেখতে পেলাম অল্প বয়সী একটা ছেলে তার সাথে আলাপ চারিতায় মত্ত হয়ে আনন্দে ভাসছে কৌতুহল বশত এগিয়ে গিয়ে গেলাম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেছি তাদের কাছে আমাকে দেখে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় এবং বলতে থাকে কিছু প্রয়োজন আপনার যদি প্রয়োজন হয় বলুন আমাদের সাথে চলুন আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম আপনি দীর্ঘক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করছিলেন এই ছেলেটি বা কে আপনি কে নিয়ে কোথায় যেতে চান আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন এই খানে উৎকট দূর্গন্ধ আপনার এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কিভাবে আপনাদের তো শরীর খারাপ করবে তার চেয়ে একটু ভালো জায়গায় যেয়ে তার পর আপনারা কথা বলুন আর আপনার চাইতে অসমবয়সী ছেলেটার সাথে আপনার কি এতো কথা যে আপনারা কথা বলতে বলতে আনন্দে হেঁসে কুটি কুটি হচ্ছেন , তখন মধ্য বয়সি ওই মেয়েটি আমাকে বলল আপনি বুঝবেন না দাদু এতেই সুখ আপনার লাগে আপনি আমার সাথে আসতে পারেন আমি বললাম কি লাগবে যা আপনি আমাকে দিবেন তখন সে আমাকে বলল আপনি চলুন আমার সাথে এগিয়ে দেখবেন আপনাকে কি দেই তখন ছেলেটি আমাকে বলল দাদু আপনি যাবেন না এখানে আপনার মতন মানুষ যায় না দাদু এখানে যাই উঠতি বয়সের কিছু মানুষ এই খান থেকে তারা মেয়েলি সুখ খুঁজতে থাকে। ঠিক তখনই আকাশের মুখ ভারী করে কালো মেঘ আকাশ ছেয়ে গেল বৃষ্টিতে ধুয়ে মিশে গেল এ প্রান্তর দ্রুত পায়ে হেঁটে বলা যায় দৌড়ে দোচালা একটি দোকানে আশ্রয় নিলাম আসার সময় বলে আসলাম হে দুষ্টু ললনা তুমি করতে পারো কত ছলনা তোমার মায়াবী ছলনায় ভুলিয়ে রাখো তুমি কত পৌরুষকে মাতিয়ে রাখ তাদেরকে আদম খেলায় নিষিদ্ধ ও জঘন্য পাপ কর্মে তবে এটুকু বলে যায় যাবার বেলায় যদি কখনো তোমার সাথে দেখা হয় সেদিন শুনব তোমার কথা না হয় কেন তুমি বেছে নিলে এই পথ কেন তুমি ভাঙলে সোনালী শপথ কেন তুমি বেছে নিলে দুর্গম আঁধারে মোড়ানো নিষ্ঠুর পথ যেথা দেহটা হারিয়ে নিজেকে উপভোগের বস্তু বানিয়ে আজ তুমি বড়ই নিঃস্ব তোমাকে পেয়ে মেতে উঠে সারাবিশ্ব।
বৃষ্টি থামার পর দ্রুত পায়ে হেটে এলাম বাজার সওদা করে বাড়িতে একাকী ভাবতে থাকলাম কেন মানুষ এমন হয় কেন নিজেকে অকারণে বিলিয়ে দেয় ওই নোংরা পচা আবর্জনায় সে কি কখনো ভাবে না সেও তো মানুষ তারও বাঁচার অধিকার আছে কারণ এই জগত সংসারের রং রূপ রস আস্বাদনের অধিকার আছে মানবিক মূল্যবোধের অধিকার তবে কেন সে নিজেকে গুটিয়ে নিল ওই নিষিদ্ধ অন্ধকার জগতে।
লোকমুখে শুনেছি নিষিদ্ধ পল্লীর কথা সেখানে মানুষের আনাগোনা চলে দিনের চাইতে রাতের আঁধারে বেশি আর যাতায়াত করে কুলি মজুর থেকে শুরু করে ধনীর দুলাল রাও শরাব পান করে মিশে যায় নগ্নতার আদিম যুগে এই সোনা কথাটা কেন জানি স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা জাগলো মনে তাই তুই একদিন পড়ন্ত বেলায় হাটি হাটি পা পা করে পৌছে গেলাম নিষিদ্ধ গলির কোলটায়, যেয়ে দেখি কত রং বে রঙের সাজ সেজে স্বল্প বসনে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত কপতি সকলেই খরিদ্দার ডাকছে যে যার মতো ধরে নিয়ে যাচ্ছে গলির ভেতর কেউবা আলো-আঁধারির মাঝে দাঁড়িয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিচ্ছে দেদারসে এ যেন এক নতুন জগৎ নতুন অভিজ্ঞতা যারা যাচ্ছে নিঃস্বংকোচে নির্ভয়ে , গলির ওখানকার পরিবেশ খুবই নোংরা আষ্ঠে পঁচা দুর্গন্ধ তবুও মানুষ গুলো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ধূমপান করছে সে কি এক অভিনব পরিবেশ।
সামনের চায়ের দোকানে এক কর্ণারে বসে এক কাপ চা হাতে নিয়ে গরম উষ্ণ জলে চুমুকে দিতে দিতে ভাবতে থাকি এরা কারা এ কেমন পরিবেশ এঁরা মানুষ নাকি অন্য কিছু যেখানে বয়সের কোন ভেদাভেদ নেই একজন মায়ের বয়সী নারীকে নিয়ে যাচ্ছে অল্প বয়সের একটি ছেলে আবার মেয়ের বয়সী একটা মেয়ে কে ও নিয়ে যাচ্ছে বাবার বয়সী একজন পুরুষ! হায়রে সমাজ হায়রে আদিম উম্মত্ততা যখন এইসব সাত পাঁচ ভাবছি তখন চায়ের দোকানদার বলতে থাকে ভাই চা গরম খাবেন না ঠান্ডা তার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে চা পান করতে শুরু করলাম এরই মাঝে অদূরেই হট্টগোল শুনতে পেলাম উৎসুক জনতা দেখছে শুনছে এক ব্যক্তির আহাজারি সে চিৎকার করে বলছে আমার সব নিয়ে গেছে আমার সব নিয়ে গেছে ওরা আমাকে কিছুই দিল না ফিরিয়ে এই কথা বলতেই পাশ থেকে দুইজন লোক এসে তাকে বেদম প্রহার করলো এমন কি পাশে থাকা ময়লা ভর্তি ড্রেনে ফেলে দিল আর কয়েক জন এসে তাকে উদ্ধার করে গা ধোঁয়ায় তাড়িয়ে দিল তখনো সে মদের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে আর আবাল তাবাল কথা বলতে থাকে কিন্তু মক্ষীরানির সেদিকে একটুও খেয়াল নেই কারণ ওরা চায় দেহের বিনিময়ে টাকা আর টাকা।
দীর্ঘ সময় ধরে চায়ের দোকানে বসে আলাপ চারিতায় জানতে পারলাম ঐখানে যারা আছে অধিকাংশের পরিবার আছে আবার পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান আছে অনেকের সেখানে তারা খুঁজে নিয়েছে স্বর্গীয় সুখ, এমনকি এই টাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে সহজ লভ্য মনে করে বিনা পরিশ্রমে উপার্জন করতে পারে বলে, এর কিছুক্ষণ পরই একটা মহিলা আসল চায়ের দোকানে ছদ্মনাম রুপা সাংবাদিকের পরিচয়ে তার সাথে কথা বলার সুযোগ পেলাম তার সাথে কথোপকথনে জানতে পারি তার বাসা বরিশাল সে প্রতারিত হয়ে এখানে এসেছে তাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে কাজ দেবার কথা বলে এনে প্রথমে রাজী না থাকায় অনেক অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে সর্বশেষ আমাকে বলল তোকে কিনে নিয়েছি ৩০,০০০ হাজার টাকা তুই রাজি না হলে আমার টাকা দিয়ে চলে যা কিন্তু আমার কাছে টাকা না থাকায় শেষ মেষ এই পথ বেছে নিয়েছি , রুপা আর ও বলে তার মতো অসংখ্য মেয়ে আছে যারা এই কাজ করতে করতে বুড়ি হয়ে গেছে আবার অনেকে নিজের কাছে ৫/১০ টা করে মেয়ে রেখে কাজ করায় নিজেরা করে না এখানে স্বেচ্ছায় কেউই এসে এই কাজ করতে চাই না বাধ্য হয়ে করে এখান থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা নেই আমাদের বাবা মা সবাই আছে কিন্তু আর কেউ নেই সবাই মনোরঞ্জন করতে পারে তবে যোগ্য সম্মান দিয়ে ঘরে তুলতে চাই না, বিভিন্ন উৎসবের সময় মন খারাপ থাকে একাকি থাকার কারণে তবুও কিছু করার নেই অনেক খরিদ্দার টাকা না দিয়ে চলে যায় কিছু বলতে গেলে মারধর খেতে হয় আমরা শান্তিতে থাকতে পারিনা আর এখানে যারা আছে তাদের প্রত্যেকের জীবনে সংঘটিত হয়েছে করুন কাহিনী যে গুলো বর্ণনা করা যায় না।
সে দিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে আসলাম ভাবলাম পরবর্তীতে আরো জানা যাবে সময় স্বল্পতার কারণে হয়ে ওঠে না হঠাৎ একদিন ছদ্মনাম জবা তার সাথে দেখা ও কথা বলে বুঝতে পারলাম যে তাকে তার পরকিয়া প্রেমিক বিবাহ করবে বলে শহরে নিয়ে আসে স্বামী স্ত্রীর মত কয়েকদিন সংসার জীবন যাপন করতে থাকে একদিন বাজার করতে হবে বলে সাথে করে নিয়ে এসে এক মাসিমার কাছে রেখে চলে যায় আর ফিরে আসেনি পরে জানতে পারি ঐ মাসিমার কাছে আমাকে বেঁচে দিছে ২৫ হাজার টাকায় সেও ফিরে এলো না আমার ও আর ঘরে ফেরা হলো না এখন শরীর বেঁচে জীবন চালায় আমি এখানে যখন নতুন এসেছিলাম তখন থেকে বাড়ি ফেরার খুব ইচ্ছে হঠাৎ একদিন আমার বাবাকে দেখি ঐ মাসিমার সাথে কথা বলতে কি বলছে শুনতে পাচ্ছিলাম না পরে দেখি যেই ঘরে আমি থাকি আমার সেই ঘরে বাবা আসছে আর মাসিমা বলছে নতুন খরিদ্দার ভালো করে আদর যত্ন করিস বাবা তখন ও জানে না আমি তার মেয়ে জবা আমার খাটে বাবা বসলো আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কেন এসেছেন তখন তিনি বললেন আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুজে বেড়াচ্ছি মেয়েটা দেখতে তোমার মত তা তোমার নাম কি মা আমি বললাম জবা আমার বাবা বল্ল যে ছেলেটা আমার মেয়েকে নষ্ট করে দিছে তাকে আমি জেলে দিয়েছি আজীবন জেলে থাকতে হবে এখন আমার মেয়েকে পেলেই আমি খুশি বাবার কাছ থেকে মা ভাই দের সকল খবর শুনে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি বাবা আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া জবা ঐ ছেলেটা আমাকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিছে আরো অনেক কথা হলো বাবা আমাকে নিয়ে যাবে বলে চলে গেলেন গরীব মানুষ আসতে অনেক দেরী হয়ে গেছে তখন মাসী বললো আমাকে নিয়ে যেতে হলে ১ লক্ষ টাকা দিয়ে নিয়ে যেতে হবে বাবার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা ঘরে তুলতে রাজি হয়নি ভাইটা ছোট সেও মায়ের ভয়ে কিছু বলতে পারে না সেই কারণে এখানে থেকে যাওয়া আমার ও আর ঘরে ফেরা হলো না তবে বছরে ২/৩ বার বাবা আসে দেখা করতে এখানে না সামনে চায়ের দোকানে বসে কথা বলে যায় কিছু জিনিস পত্র দিয়ে যায় এভাবে কষ্টের মধ্যে জীবন কাটছে আমার ও এই নীল দুনিয়ার সব মেয়েদের।
এখন আপনি বলুন তো এই পথে আমাদের কে বা কারা এনেছে তারা সকলেই পুরুষ মানুষ কারো ভাই ছেলে আপনজন যাদের কথা শুনে আজ আমরা হয়ে গেছি নীল দুনিয়ার অধিবাসী নীলকন্ঠী কেউ আমাদের বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায় আবার কেউ ভোগ করে টাকার বিনিময়ে যারা আমাদের পতিতা বা মক্ষীরানি বলেন তাদের ভাবা উচিত এসবের জন্য কারা দায়ী আমরা জানি এটা খারাপ কাজ কিন্তু এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কেউ চাইবে না আমাদের সাথে সংসার করতে এখানে তো দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে আছি বাইরে সে পথ ও বন্ধ সেজন্য এখানে জীবন কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। সে কারণে আদিম ইতিহাস খুঁজতে শুরু করলাম
এবার আসি পতিতাবৃত্তির ইতিহাস সম্পর্কেঃ
পতিতা, গণিকা, বারনারী, বেশ্যা যাই বলি-ঐ এক শ্রেণীর নারীকেই বোঝায়। যারা টাকার বিনিময়ে নিজের দেহকে অন্যের হাতে তুলে দেয় পুরুষের ভোগ-বিলাস, আনন্দ-ফূর্তির উদ্দেশ্যে। আমাদের সমাজ এদের ভালো চোখে দেখে না। সমাজের মানুষ গুলো নিজের মনের ক্ষুধা মেটায়, তারপর এদের ফেলে দেয় ডাস্টবিনে, আবার যখন মনে ক্ষুধা লাগে তখন সেই ডাস্টবিন থেকে তুলে চেটে-পুটে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করে।
ডা. লুৎফর রহমানের একটি কথা “এই সমাজে যদি তাদের (গণিকাদের) প্রয়োজন নাই থাকতো তাহলে তারা অনেক আগেই হরিয়ে যেত”। এই কথাটি অক্ষরে অক্ষরে ঠিক, অপ্রয়োজনীয় কোন জিনিস কখনো টিকে থাকে না। সমাজের আমি, আপনি বা আমরাই এই বৃত্তিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছি। জীবনভর আমার আপনার প্রয়োজন মেটানোর পরেও সে আমার আপনার চোখে খারাপ। গণিকাবৃত্তি নিয়ে এক নারী একটা কথা বলেছিল – “দেখ যদি তোরা ফ্রিতে সব কিছু পাইতি তাহলে আর খারাপ বলতি না, তখন সেবা দানকারী বলতি”। আমার কাছেও এই কথাটি যৌক্তিক মনে হয়েছে।
এইবার ইতিহাসের পালাঃ
বলাহয় সভ্যতার যে কয়টি পেশা আদিকাল থেকে চলে আসছে তার মধ্যে অন্যতম হলো পতিতাবৃত্তি। মানব সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই এই পেশা চলে আসছে। এই বার দেখা যাক কিভাবে এই পেশা আদিম পেশা এবং এর ইতিহাস কতটুকুই প্রাচীন..
প্রাগৈতিহাসিক যুগঃ
আমরা সবাই জানি প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ খাদ্য উৎপাদন না করে খাদ্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। এই সময় মেয়েরা খাদ্য (ফলমূল) সংগ্রহ করত এবং পুরুষরা শিকার করত। এই শিকারের কাজে অনেক সময় পুরুষকে অনেক দূরে যেতে হতো… যাতে তাদের দুই-চার বা সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগত ফিরে আসতে। এই সময় পুরুষ হয়তো শিকার করতে করতে অণ্য একটি গোত্রের কাছে চলে যেত। এই সময় পুরুষের যদি কোন নারী সঙ্গ দরকার হতো তখন ঐ গোত্রের নারীর সাথে সে সঙ্গম করতে পারত। তবে এই সঙ্গমের বিনিময়ে তাকে শিকারের কিছু অংশ দিতে হতো। আর এর মাধ্যমেই দেহের বিনিময়ে অর্থেরে ধারণাটি প্রচলিত হয়। নৃবিজ্ঞানীদের মতে এখন থেকেই পতিতা বৃত্তির শুরু।
তবে প্রাগৈতিহাসিক সময় কালের পতিতাবৃত্তি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেক নৃবিজ্ঞানীই মনে করেন প্রাগৈতিসাহিক কালে বিবাহ প্রথা ছিল না। এই সময় মানুষ যৌনস্বাধীনতা ভোগ করত। পরবর্তীতে বিবাহ প্রথা চালু হবার কারণে বিশেষ করে একপত্নী দ্বারা- যেদিন থেকে ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষের যৌন স্বাধীনতাকে খর্ব করে সেই দিন থেকেই এই ব্যবসার জন্ম হয় বলে অনেকেই মনে করেন।
ঐতিহাসিক যুগে গণিকাবৃত্তিঃ
প্রাচীন ব্যাবিলন, ভারতবর্ষ, গ্রীস, রোম সহ সকল প্রাচীন সভ্যতায়ই এই বৃত্তি নানা ভাবে প্রচলিত ছিল।
ব্যাবিলনঃ
প্রাচীন ব্যাবিলনে পতিতাবৃত্তিকে পূন্যের কাজ মনে করা হতো। আর এই কারণে প্রত্যেক বাড়ি থেকেই প্রত্যেক নারীকে জীবনে অন্তত একবার টাকার বিনিময়ে দেহদান করতে হতো। ঐতিহাসিক হেরোডেটাস তার বর্ণনায় লিখেছেন- “মাইলিত্তা (ব্যাবিলনীয়দের রতিদেবী (Mylitta) দেবীর মন্দিরে প্রত্যেক নারীকেই অন্তত একবার যেতে হতো। তারা মন্দিরে লাইন ধরে বসে থাকত। এই মন্দিরে যে সকল পুরুষ আসত তারা নিজেদের পছন্দ মতো নারীকে রৌপ্যমুদ্রা নিক্ষেপ করত এবং বলত তোমার উপর মাইলিত্তার আর্শিবাদ বর্ষিত হোক। এই কথা বলার সাথে সাথে উক্ত নারী মুদ্রা নিক্ষেপকারী পুরুষের সাথে কোন নির্জন স্থানে গিয়ে দেহ দান করত”। এই বিষয়টিকে ব্যাবিলনীয়রা ধর্মানুষ্ঠান মনে করত বলে কত টাকা দেয়া হলো সেটা বিচার করা হতো না। এখানে বিষয় হলো সুন্দর নারীরা খুব সহজেই নিজের খদ্দের পেয়ে যেত কিন্তু কুৎসিত নারীরা সহজে পেতনা। তাদের অনেক সময় দুই-তিন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। আর যতদিন পুরুষের সাথে মিলিত হতে না পরত ততদিন ঘরে ফেরার নিয়ম ছিল না। হাম্বুবারীর আইনেই পতিতাদের কথা উল্লেখ আছে, তাদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে এই আইনে।
ভারতবর্ষেঃ
প্রাচীন ভারতে পুরোহিতদের প্রভাব ছিল খুব বেশি। এই সময়ের পুরোহিতরা অনেক সময় নিজেকে দেবতার সাথে তুলনা করতেন। পুরোহিতদের সম্পর্কে এমনও বলহয় যে- কোন নব-বিবাহিতা নারীর স্বামীর সাথে রাত কাটানোর পূর্বে পুরোহিতের সাথে রাত কাটাতে হতো। এছাড়াও পুরোহিতরা মনে করত -স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র সহ অন্যান্য দেবতাদের চিত্ত বিনোদনের জন্য অপ্সরা, মেনেকা, রম্ভা অপ্সরাগণিকারা আছে , তাই পৃথিবীতেও থাকা দরকার। আর এই ধারণা থেকেই বড় বড় মন্দির, তীর্থস্থানগুলোতে দেবদাসী রাখা হতো। পুরোহিতরা মনে করত – এরা দেবতার সেবা করবে, আর দেবতার কাছে সেবা পৌছে দেবার পথ হলো পুরোহিতকে সেবা করা। এই সকল দেবদাসীরা অনিন্দ্য সৌন্দর্যের অধিকারী হতো। অনেক সময় এলাকার সুন্দরী নারীকে ধরে এনে দেবদাসী বানানো হতো । এই সকল দেবদাসীদের সাথে পুরোহিতদের অবৈধ যৌনক্রিয়া চলত। অনেক সময় পুরোহিতরা মন্দিরের অর্থ উপার্যনের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষের সাথেও সঙ্গমের অনুমতি দিত।
কিভাবে দেবদাসী মন্দিরে আনা হতো তা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে- এটাও শোনা যায় যে- কোন কোন ধর্মপ্রাণ পিতা-মাতা নিজকন্যাকে দেবতার সাথে বিয়ে দিয়ে তারা দাসী করে দিতেন। এই দেবদাসীরা দেবতার মূর্তির সামনে নৃত্য করত। এদের স্বতীত্ত্ব রক্ষা করে চলতে হতো । যদি কোন কারণে চরিত্রে দোষ পাওয়া যেত তাহলে মন্দির থেকে বের করে দেয়া হতো। তবে স্বাভাবিক ত্বারণায় এবং পুরোহিতের লালসার (আর্থিক/ দৈহিক) কারণে এই স্বতিত্ত্ব ধরে রাখা সম্ভব হতো না।
গ্রীসের পতিতাবৃত্তিঃ
গ্রীক দেবী ভেনাস ও আফ্রোদিতিকে পতিতাদের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই দুই জনের মূর্তি প্রকাশ্যে পূজা করা হতো। আর এই পূজার ব্যায় ভার বহন করা হতো মন্দিরের পতিতাদের আয়ের টাকা থেকে। প্রাতি মাসের চতুর্থ দিনে এই পূজা করা হতো। কোরিন্থ (Corinth) মন্দির হাজারের উপর পতিতা থাকত। কারণ বাবা-মা এই সকল নারীদের মন্দিরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন এবং পূন্য লাভের আশাই এই পতিতাবৃত্তি করত।
গ্রিক দার্শনিক ও আইনবিদ সলোন (Solon) । তিনি একবার আইন প্রনয়ন করেন যে পতিতারা রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এদের আয়ের টাকা দিয়ে আফ্রোদিতির মন্দির নির্মান ও সংস্কার করা হবে। সলোনের সময় গ্রীসের নারীরা স্বেচ্ছায় মন্দিরে আসত না বিজিত অঞ্চলের সকল নারীকেই জোর করে মন্দিরে রাখা হতো পতিতাবৃত্তির জন্য। এরা রাষ্ট্রের সম্পদ ছিল বলে তাদের যদি কোন অসুখ বিসুখ হতো তাহলে কোন চিকিৎসা করা হতো না। দুই একজন পতিতা ছাড়া বাকি পতিতাদের জীবন ছিল খুব কষ্টের। খদ্দের কে আকৃষ্ট করার জন্য তারা রাস্তার পাশে নগ্ন হয়ে দাড়িয়ে থাকত। আবার অনেক সময় পথের পাশে তারা যৌনসঙ্গমও করত খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্য।
হেতায়ারা (Hetaira) নামে এক শ্রেণীর উঁচু দরের পতিতা ছিল গ্রিসে। এরা ছিল গ্রিসের কবি, দার্শনিক, সেনাপতি, রাজপুরুষের ভোগের সামগ্রী। যেহেতু এরা প্রভাবশালী মানুষের মনোবঞ্জন করত তাই তাদের শিক্ষিত ও শৈল্পিক মনের অধিকারী হতে হতো। এর বাসগৃহ বেশভূষা ছিল চাকচিক্যময়।
গ্রিক সভ্যতায় উপপত্নী প্রথা প্রচলিত ছিল। এ প্রসংঙ্গ ডেমসথিনিসি (Demosthenese) বলেন “ হেতায়রা আমাদের বিলাসিতার জন্য, উপপত্নীরূপে, প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য, স্ত্রী আইন স্বীকৃত পুত্র-কণ্যার জন্য। স্ত্রী অন্তঃপুরে অনুগত থেকে বৃদ্ধা হবে”।
উপপত্নীর গর্ভে যদি কোন সন্তান জন্ম নিত তাহলে সে কোন নাগরিক বা সম্পত্তির অধিকার পেত না।
রোমেঃ
রোমের পতিতাদের অধিকাংশই ছিল বিজিত অঞ্চলের নারীরা। রোমান সাম্রাজ্যের চরম উন্নতির সময় নারী-পুরুষ একত্রে উলঙ্গ অবস্থায় গোসল করার প্রথা চালু হয়। এর ফলে সমগ্র ইতালি জুড়ে অনেক হাম্মামখানা চালু হয়। এই হাম্মামখানা গুলো হয়ে উঠে যৌনাচারনের কেন্দ্র। রোমে পতিতাবৃত্তি এতই প্রসার হয়েছিল যে- সাকার্স, থিয়েটার, মেলা, তীর্থস্থানগুলোতে গণিকাতে পরিপূর্ণ থাকত। তারা স্বাধীনভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারত এবং তাদের খদ্দের ধরতে পারত। দেশর সকলেই বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে হাম্মামখানা ও বারাঙ্গনা ভবনগুলোকেই বুঝত। এই সময় এই হাম্মামখানা ও বারাঙ্গানা ভবনগুলোতে অনেক বিবাহিত পুরুষ নিজের স্ত্রীকে বিক্রি করে দিত। বড় বড় সম্রাট্রের স্ত্রীরাও নির্জন স্থান বাড়ি ভাড়া করে সম্রাটের অজ্ঞাতে পতিতাবৃত্তি করত। সম্রাট ক্লাডিয়াসের স্ত্রী মোনালিসা এই অপরাধে সম্রাটের আদেশে নিহত হন।
মধ্যযুগে ইউরোপের পতিতাবৃত্তিঃ
মধ্যযুগে (৫০০-১৫০০ খ্রিঃ) সময়ে পৃথিবীর সর্বত্রই পতিতাবৃত্তির প্রসার লক্ষণীয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি দেশ শিল্পেউন্নত হয়। সৈন্যদলের উপভোগের জন্যও একদল ভ্রাম্যমান পতিতা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল। ক্রুসেডের সময় এই প্রথা গড়ে উঠলেও ক্রুসেড শেষ হওয়ার পরেও এই ব্যবসা চলতে থাকে।
ইংল্যান্ডেও অন্যান্য দেশের মতো পতিতা ব্যবসা প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রীয় কোন পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের পতিতালয়সমূহ সরকারী স্নানাগারসমূহে কেন্দ্রীভূত হয়। এই সময় ১৫৪৬ সালে রাজা অষ্টম হেনরী আইন করে পতিতা ব্যবসা বন্ধ করেন । কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে পতিতারা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। ১৬৫০ সালে আইন করে আরো কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলেও গোপনে পতিতাবৃত্তি চলতে থাকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের অধিবাসীদের সাথে ইংল্যান্ডের অধিবাসিদের মেলামেশার করাণে ফরাসী রীতিনীতি ইংল্যান্ডের ফ্যাশন হয়ে দাড়ায়। এবং ফরাসীদের অবাদ যৌনাচারণের প্রভাব ইংল্যান্ডেও পড়তে থাকে। লন্ডনের French Quarter এ পতিতাদের আড্ডা খানায় পরিণত হয়। এই সময় থিয়েটারগুলোতেও পতিতাদের আধিপত্য লক্ষ্যকরা যায়। এখানেও তারা যৌনব্যবসা করত। এছাড়াও সমুদ্রবন্দরগুলোতেও পতিতাদের ভীড় লক্ষ্য করার মতো ছিল। এই সময় নাবিক ও সৈনিকদের মধ্যে যৌন জনিত রোগ ভয়াবহ আকারে দেখা দিলে ১৮৬২ সালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি পতিতাদের হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য পরামর্শ দেয়। ১৮৬৪ সালে আইন করে পতিতাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
জাপানের পতিতাবৃত্তিঃ
সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত জাপানে গণিকাবৃত্তি অসংঘবদ্ধ ছিল। এই সময় পতিতারা এই এলকা থেকে অন্য এলকাতে ঘুড়ে বেড়াত। এই শতাব্দীতে পতিতা গুলোকে একত্রি করার চেষ্টা করা হয়। ইয়োডো অঞ্চলে অনেক পতিতাকে একত্রিত করা হয়। এবং এই সময় হতেই এই ব্যবসা লাভ জনক ব্যবসায় পরিণত হয়। ১৬১২ সালে একটা স্থায়ী কেন্দ্রের জন্য আবেদন করা হয় এবং ফুকিয়া মাচি এলাকাতে জঙ্গলাকীর্ণ একটি স্থান দেয়া হয়। পতিতারা এখানে অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় করে একটি সুন্দর শহর গড়ে তোলেন এবং এর নাম করণ করা হয় য়োশিওয়ারা। এর ৩০ বছর পর সরকার এই এলাকাটি খালি করার নিদের্শ দেন এবং পরবর্তীতে সরকার এই অঞ্চলের পাশেই আরেকটি জায়গা বরাদ্দ করেন পতিতাদের জন্য। ১৮৭২ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলেই তারা পতিতা ব্যবসা করে। জাপানের পতিতাদের একটি উল্লেখ যোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল তারা ইচ্ছে করলেই সমাজে ফিরে যেতে পারত এবং সমাজও তাদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করত। এছাড়া যে সকল পতিতা সমাজে ফিরে আসত সরকার তাদের চাকুরীর ব্যবস্থা করত।
বাংলাদেশের পতিাতবৃত্তিঃ
বাংলাদেশের পতিতালয়ের বিকাশ ঘটে মূলত ইংরেজদের সময় থেকেই । এই সময় ইংরেজ বণিকগন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাণিজ্য করতে যেত। এই সময় তারা তাদের মনো রঞ্জনের জন্য পতিতা সাথে রাখত। এছাড়া ঐসময় বাণিজ্যকেন্দ্র গুলোর আশে পাশে পতিতালয় গড়ে উঠে। বিশেষ করে নৌ-পথ বা সমুদ্র-পথের কাছা কাছি পতিতাপল্লী দেখা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোন ভ্রাম্যমান পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ। তবে যদি কোন ভ্রাম্রমান পতিতাকে আটকানো হয় তাহলে তার শাস্তি হলো ৫০ টাকা জরিমান অথবা ৭ দিন কারাদন্ড। বাংলাদেশে মোটামুটি বৃহৎ পরিসরে পতিতালয় আছে ১৪টি। এই পতিতালয় গুলো বাণিজ্যিক অঞ্চলের আশেপাশেই অবস্থিত।