উপন্যাস: নীলকন্ঠী। তৃতীয় পর্ব।
লেখক: কাজী খলিলুর রহমান।
তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য অপ্সরা রম্ভাকে প্রেরণ করেন। কিন্তু বিশ্বমিত্রের অভিশাপে রম্ভা শিলাতে পরিণত হয়ে ১০০০ বছর অবস্থান করেন।রম্ভা যখন বিশ্বমিত্রের আশ্রমে শিলারূপে বাস করছিলেন তখন অঙ্গকার নামে একজন রাক্ষসী সেখানে নানা উপদ্রব করতে আরম্ভ করেন। তখন ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলাখণ্ড দুই ভাগে ভাগ করে রাক্ষসকে উদ্দেশ্য করে নিক্ষেপ করেন। অস্ত্রের ভয়ে ভীত হয়ে রাক্ষসী পলায়ন করে কপিতীর্থে এলে তার মাথায় সেই শিলা খণ্ড পড়ে রাক্ষসের মুত্যু হয়। এই শিলাখণ্ড কপিতীর্থে নিমগ্ন হলে রম্ভা আবার নিজের রূপ ফিরে পান।(৩) ইন্দ্র সভায় নৃত্যকালে রম্ভার তালভঙ্গ হয়। তখন ইন্দ্র ক্রদ্ধ হয়ে রম্ভাকে অভিশাপ দেন, রম্ভা স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ হয়ে ভূতলে পতিত হন। পরে নারদের পরামর্শে শিবের পুজো করে পুনরায় স্বর্গে ফিরে যান।(৪) ইন্দ্রের আদেশে রম্ভা জাবালি মুনির তপোভঙ্গ করেন। মুনির ঔরসে রম্ভার এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। জাবালি এই কন্যার প্রতিপালন করেন; এই কন্যার নাম ফলবতী।
তিলোত্তমা দৈত্যরাজ নিকুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দ ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করে ত্রিলোক বিজয়ের জন্য অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা এদের অমরত্বের বরদান করতে সম্মত হননি। তবে তিনি বলেন যে, স্থাবর-জঙ্গমের কোনো প্রাণী তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। যদি এদের মৃত্যু হয় তবে পরস্পরের হাতেই হবে। এই বর পাওয়ার পর তারা দেবতাদের উপর নিপীড়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন দেবতারা প্রাণ রক্ষা করার জন্য ব্রহ্মার নিকট প্রার্থনা করেন এদের নিকেশ করার জন্য। ব্রহ্মা এদের নিকেশ করার জন্য পরমা সুন্দর এক রমণীর সৃষ্টি করলেন। ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম জিনিস তিল তিল করে সংগ্রহ করে ব্রহ্মা এক অতুলনীয়া নারী সৃষ্টি করেন। তিল তিল সুন্দর বস্তু মিলিত হয়ে এই সুন্দরী সৃষ্টি হয়েছিল বলে এর নাম হয় তিলোত্তমা। তিলোত্তমাকে সৃষ্টির পর ব্রহ্মা সুন্দ ও উপসুন্দরের নিকট পাঠিয়ে দেন। স্বর্গবেশ্যা তিলোত্তমা এদের দুজনের সামনে নগ্ন হয়ে নৃত্য করতে থাকে। সুন্দ ও উপসুন্দ তিলোত্তমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাওয়ার জন্য পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হন। ফলে একে অন্যের হাতে নিহত হন।
উর্বশীও একজন পরমা সুন্দরী স্বর্গ গনিকা। অভিশাপের ফলে উর্বশী মানুষরূপে জন্ম নেন। স্বর্গ গনিকা উর্বশীকে দেখে বুধপুত্র পুরূরবা প্রেমাসাক্ত হয়। দুজন দুজনের প্রেমে মগ্ন। উর্বশীকে ছাড়া পুরূরবার চলে না। উর্বশী কয়েকটি শর্তে পুরূরবাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শর্তটি হল — উর্বশী যেন কোনো দিন স্বামী পুরূরবাকে নগ্ন অবস্থায় না দেখেন।যদি দেখেন তবে সেদিনই উর্বশী পুরূরবাকে ত্যাগ করবেন। পুরূরবা উর্বশীর সকল শর্ত মেনে নিয়ে বিয়ে করে। সুখেই তাদের দিন কাটছিল। এদিকে স্বর্গের দেবতারা উর্বশীকে ফিরিয়ে আনতে উঠেপড়ে লাগলেন। এক রাতে বিশ্বাবসু উর্বশীর প্রিয় দুটি মেষ চুরি করেন। পুরূরবা মেষদুটি উদ্ধার করতে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই বিছানা থেকে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ঠিক তখনই বিদ্যুতের প্ররোচনায় রাতের অন্ধকার ক্ষণিকের জন্য দূর হয়, সেই ক্ষণকালেই উর্বশী চোখের সামনে নগ্ন পুরূরবা প্রকট হয়ে পড়ে। শর্তমতে তখনই উর্বশী পুরূরবাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যান। শোকাহত পুরূরবা পাগলের মতো উর্বশীর সন্ধানে দেশবিদেশে ঘুরে-বেড়ায়। অনেকদিন পর অবশ্য সে অপ্সরারূপে উর্বশীর দেখা পায়। চরিত্রবান পুরূরবা বর হিসাবে উর্বশীর সঙ্গে পুরো জীবন কাটাতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে দেবতারা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন এবং স্বর্গলোকে স্থান দেন।
স্বর্গের আরও একজন প্র্রসিদ্ধ স্বর্গ গনিকা ঘৃতাচী। ইনি ইন্দ্রের আদেশে নিজের নগ্ন রূপ দেখিয়ে বহু মুনিদের তপস্যা ভঙ্গ করেছেন। ঘৃতাচীকে দেখে ভরদ্বাজ ঋষির শুক্র স্খলিত হওয়ায় দ্রোণের জন্ম হয়। তাই দ্রোণের মাতা না হলেও তাঁর জন্মের মূলে ছিলেন ঘৃতাচী। চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির সঙ্গে ঘৃতাচীর মিলনে রুরুর জন্ম হয়। একবার ব্যাসদেব সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে একবার যখন হোমের আয়োজন করছিলেন, সে সময় ঘৃতাচী উপস্থিত হন। ঘৃতাচীকে দেখে ইনি অত্যন্ত কামাবিষ্ট হন। ব্যাসদেবের এরূপ অবস্থা দেখে ঘৃতাচী শুকপাখির রূপ ধরে পলায়ন করেন। কিন্তু ব্যাসদেবের প্রবল কামনার কারণে তাঁর বীর্যস্খলন হয় এবং তা অরণির উপর পতিত হয়। ব্যাসদেব উক্ত অরণি মন্থন করতে থাকলে একটি পুত্রের জন্ম হয়। ঘৃতাচী শুক পাখির রূপ ধরে পলায়ন করেছিলেন বলে ব্যাসদেব এর নাম রাখেন শুক।
এইসব গনিকারা ছিলেন অনন্তযৌবনা, তাই “দেবরাজ” ইন্দ্র গুপ্তচরবৃত্তি এবং গুপ্তহত্যার কাজে নিয়োগ করতেন। রামায়ণে তো প্রচুর গনিকা এবং গুপ্তচর বৃত্তির কাজে রূপাজীবা নিয়োগের কথা উল্লেখ আছে। রামচন্দ্রের অভিষেকের সময় প্রচুর বেশ্যা অংশগ্রহণ করেছিল। রামায়ণের যুগে বিশিষ্ট অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় এ রাজপরিবারের মানুষদের মৃগয়ায় বেশ্যা বা গণিকাদের নিয়োগপ্রথা চালু ছিল। গণিকা কর্তৃক ঋষ্যশৃংগের প্রলোভন আখ্যান রামায়ণে সুখ্যাত হয়ে আছে। মহাভারতের যুগে “বিষকন্যা” নামক এক শ্রেণির সুন্দরী গণিকাদের কথা জানা যায়। এরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কাজ ছিল – যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্ত দংশনে এরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে বিষ ঢেলে দিত। সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত এবং পুরুষাঙ্গটিও কেটে ফেলা হত। বিষকন্যা গণিকাদের সবচেয়ে বেশি আধিক্য দেখা যায় ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়। বিশাখদত্তের “মুদ্রারাক্ষস” নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে এক বিষকন্যার উল্লেখ আছে, যে নন্দরাজের মন্ত্রী রাক্ষস নিয়োগ করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত (মৌর্য)-কে হত্যা করার নিমিত্তে। এহেন বিষকন্যারা একাধারে বহুপুরুষগামী, অপরদিকে হত্যাকারীও।
মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনিঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা “স্বর্গবেশ্যা”-দের দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন-সংসর্গে মিলিত হয়েছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই সেইসব গুণধর ! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এরা মনোহর রত্ন সোনা ও মণিমু্ক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে তাঁরা রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনো অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রার আয়োজন হলে পুরোভাগে বস্ত্রালংকারে শোভিত সুন্দরী বেশ্যারা থাকতেন।
শুধু সুরলোকেই নয়, দেবলোকেও বেশ্যাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে ত্বষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন ত্রিশিরা। ত্রিশিরা ছিলেন একাধারে মদ্যপ এবং নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর উদ্দেশ্য স্বর্গজয়। স্বভাবতই স্বর্গরাজ ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে বেশ্যাদের শরণাপন্ন হলেন ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী গনিকাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ ইন্দ্র। মহাভারতের যুগে সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী গনিকাদেরকেও স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণ ও আনন্দদানের জন্য সেনাশিবিরে এদের মজুত রাখা হত। যুযুধান দুই পক্ষ পাণ্ডব ও কৌরব সেনাশিবিরে অসংখ্য সৈন্যদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য শত সহস্র বেশ্যা নিয়োগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যে সব সুন্দরী “বেশস্ত্রী” অর্থাৎ বেশ্যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল তাঁদের সুযোগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপরই ন্যস্ত ছিল। রামায়ণের রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী গনিকাদের নিয়োগ করা হয়েছিল।
প্রাচীন যুগে গনিকাদের বিবরণ বর্ণনা করতে চাইব অথচ বাৎস্যায়নে “কামসূত্রম্” উল্লেখ করব না, তা হয় নাকি ! সবার আগে সংক্ষেপে জেনে নিই কী আছে বাৎস্যায়নের “কামসূত্রম্”-এ। আছে নরনারীর কামকলার যাবতীয় তথ্য, এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর বিশদ বর্ণনা। আছে লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ও যোনির বিস্তার অনুসারে নরনারীর প্রকারভেদ, স্বভাব অনুসারে নারীর বৈশিষ্ট্য-চুম্বন-আলিঙ্গনাদি, স্তনমর্দন, দংশনক্ষত, নখক্ষত, যৌনমিলনের বিভিন্ন ভঙ্গি তথা আসন এবং প্রয়োগবিধি, পত্নী নির্বাচন, পত্নী এবং উপপত্নীর লক্ষণ, পরস্ত্রীকে বশীভূত করার উপায়, কৃত্রিম লিঙ্গের ব্যবহার, যোনির বিস্তৃতি এবং সংকোচনের উপায়, বিভিন্ন প্রকার বিবাহ, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলন, রতিক্রিয়ার উপযুক্ত স্থান প্রভৃতি। এই “কাম-সূত্রম্”-এর ‘বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় বেশ্যাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে বেশ্যাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত বেশ্যাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বধ্যমূল ধারণার বদল হতে পারে।
“চারুদত্ত” গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনি উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। এখানে চারুদত্ত নামে জনৈক ব্রাহ্মণের সঙ্গে বেশ্যা বসন্তসেনার বিয়ে হয়। এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মদনিকা নামক বিয়ের কাহিনিও এই গ্রন্থে আছে।
মধ্যযুগের সাহিত্যেও বেশ্যা-বারাঙ্গনা ছিল। গোপীচন্দ্রের গান, ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল, দোনা গাজির সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, আবদুল হাকিমের লালমতি সয়ফুল মুল্লুক, শুকুর মাহমুদের গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস — এইসব নানা কাব্যপুথিতে বেশ্যা-সংস্কৃতির সরস বিবরণ রয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার জতুগৃহ প্রাচীন গ্রিকের এথেনাইয়ের কবি সোলোন , যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসেবে গণ্য হতেন, খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন। এই বেশ্যালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে পতিতাবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং পৌরসভার মাধ্যমে সমস্ত বেশ্যালয় পরিচালিত হতে থাকে।প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যারা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের উপর বেশ্যাদের সহায়তায় নজর রাখতেন এবং রাজার কাছে গোপন রিপোর্ট দিতেন।
ধর্মীয় সংস্কার-আচার-প্রথা ও ‘পবিত্র পতিতা’-র জন্ম দিয়েছে। লোকজীবনে দেহসাধনার নামে যে অবাধ যৌনাচার চলে আসছে তাতে ভণ্ড পির, কামুক সাধু কিংবা বৈরাগী-বৈষ্ণবের আখড়াও বাদ যায় না। “তন্ত্রসার” গ্রন্থে ভুরি ভুরি বেশ্যার উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে বেশ্যারমণীদের চারভাগে ভাগ করা হয়েছে – যেমন (১) গুপ্তবেশ্যা : এই বেশ্যারা সাধারণত তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিকদের বংশজাতা হয়। এরা স্বভাবে নির্লজ্জ এবং অত্যধিক কামাসক্ত হন। এরা পশুভাবাপন্ন স্বামী বা পুরুষ পছন্দ করেন।(২) মহাবেশ্যা : এই মহাবেশ্যারমণীরা স্বেচ্ছায় শরীরের পোশাক ত্যাগ করে গুপ্ত-অঙ্গ প্রদর্শন করেন। (৩) রাজবেশ্যা : রাজবেশ্যারা স্বাধীনভাবে নগরে বিচরণ করণে এবং রাজার মতোই আচরণ করেন (৪) দেববেশ্যা : যে রমণী মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে তান্ত্রিক-চক্রে অধিষ্ঠিতকালে যৌনমিলন সম্পাদনের মাধ্যমে গর্ভবতী হন, সেই নারীর গর্ভজাতা কন্যাই দেববেশ্যা নামে অভিহিত করা হয়।
নিরুত্তরতন্ত্রে আবার মোট ছয় প্রকারের বেশ্যার উল্লেখ আছে। যেমন – (১) গুপ্তবেশ্যা, (২) মহাবেশ্যা, (৩) কুলবেশ্যা, (৪) রাজবেশ্যা, (৫) ব্রহ্মবেশ্যা এবং (৬) মহোদয়া। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এইসব বেশ্যারা এক-একটি প্রসিদ্ধ তীর্থতুল্য।যেমন – গুপ্তবেশ্যারা অযোধ্যা তীর্থতুল্য, মহাবেশ্যারা মথুরা তীর্থতুল্য, কুলবেশ্যাগণ মায়া তীর্থতুল্য, রাজবেশ্যাগণ দ্বারকা ও অবন্তী তীর্থ তুল্য, ব্রহ্মবেশ্যাগণ দ্বারাবতী তীর্থতুল্য এবং মহোদয়া বেশ্যারা কালিকা তীর্থতুল্য।নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে, “স্ত্রী পুংসো সঙ্গমে সৌখ্যং জায়তে তং পরমং পদম্”।অর্থাৎ, স্ত্রী ও পুরুষের সঙ্গমে যে সৌখ্য বা আনন্দ তাই-ই পরমপদ বা ব্রহ্ম। সেই কারণেই তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্রে ‘পঞ্চ ম-কার’ অপরিহার্য অঙ্গ। পঞ্চ ম-কার হল মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন।“বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্ত্বা মৎস্যমাংসং রজস্বলাং।/যো জপেদ্ দক্ষিণাং কালীং তস্য দুঃখ পদে পদে”।।– অর্থাৎ “যে বিনা মদ্যপানে, বিন মাছমাসং খেয়ে, বিনা যুবতী সম্ভোগে দক্ষিণা কালীর আরাধনা করবে তাঁর পদে পদে দুঃখ হবে”।
সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ’ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে – এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন৷ এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৮ সালে৷ আশা ছিল, এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হয়ে যাবে৷ কিন্তু তা হয়নি৷ এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িশায় এবং গুজরাটে দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজে ব্যবহার করা হয়৷ দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী৷ কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী৷
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ এর পেছনে আছে চরম দারিদ্র্য, জাতিভেদ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত “বিয়ে” দিয়ে দেন৷ এরপর অন্য কোনো পুরুষ ওই মেয়েটির স্বামী হতে পারে না৷ খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাঁদের সারাজীবন কাটে কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হয়ে৷ কিংবা সমাজের উচ্চ বর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়৷ মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামন্ত-প্রভুদের যোগসাজশে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের উপর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিকে দেয়া হয় ধর্মীয় শিলমোহর৷ উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের৷ এই সামজিক তথা ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত৷ এর ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক উৎকীর্ণ আছে বিভিন্ন মন্দির গাত্রে৷ গুজরাটে প্রায় চার হাজার মন্দিরে ছিল প্রায় ২০ হাজার দেবদাসী, যাঁদের নাচনিও বলা হত৷
শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার তাম্রশাসন আমলের লেখমালায় সংগীত-নৃত্য পটিয়সী রাজনটী ওরফে রাজবেশ্যাদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও আবার কখনো বেশ্যা ও বেশ্যাবৃত্তির জীবনযাপন করতে হয়েছে। দেবদাসী প্রথা তার একটি বড়ো দৃষ্টান্ত। কালীঘাটের পটচিত্রে বেশ্যাসম্ভোগের দৃশ্য যেমন আছে, তেমনই অনেক মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য মেলে। পাশ্চাত্য শিক্ষার আনুকূল্যে উনিশ শতক বাঙালি সমাজের সার্বিক উত্থানের কাল হয়ে উঠেছিল। অবশ্য এর পাশাপাশি সমাজ-অভ্যন্তরে অনাচারের একটি চোরাস্রোতও বহমান ছিল। ভুঁইফোঁড় নব্যধনী এবং সেই সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যেও চারিত্রিক ভ্রষ্টাচার দেখা দেয়। এমনকি সমাজের নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এই নৈতিক স্খলন থেকে মুক্ত ছিলেন না। সুরাপান, বেশ্যাসক্তি ও রক্ষিতা-পোষণ সেকালে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণিকাচর্চা গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হত।আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক জীবন এমনকি মফস্বল শহরেও গণিকাচর্চা জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠে। নব্যবাবু সমাজে ‘বেশ্যাবাজি’ ছিল বাবুগিরির প্রধান অঙ্গ। আমাদের রথী-মহারথীদের কিছু নাম জেনে নেই যারা হামেশাই বেশ্যাবাড়ি যেতেন।ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় নিকির নাচ দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বাঁধা রক্ষিতাও ছিল তাঁর।এই যবনী রক্ষিতার গর্ভে তাঁর একটি পুত্রও জন্মে ছিল।দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাগান বাড়ি বিলাস ও বাইজি আসক্তি তাঁর সাধ্বী পত্নী বরদাস্ত করেননি।দ্বারকানাথকে বহির্বাটীতেই রজনী যাপন করতে হত, অন্দরমহলে প্রবেশ তাঁর জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। কলকাতার বউবাজারে দ্বারকানাথের পরিবারের কোনো সদস্যের মালিকানায় ৪৩ কক্ষের এক বিশাল বেশ্যাবাড়িও ছিল। কারও কারও ধারণা, নটী সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর — কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার কারণ নাকি এই অবৈধ সম্পর্ক। ব্যভিচারী রমেশদার আত্মকথায় ঠাকুরপরিবার সম্পর্কে চাঞ্চ্যকর কিছু তথ্যের সন্ধান মেলে। প্রতিবেশী সম্পন্ন মুসলমান সম্প্রদায়ও এই হিন্দু বাঙালি’বাবু’দের অনুসরণ করতেন। পদমদীর নবাব মির মহম্মদ আলি তাঁদেরই একজন। সত্যনিষ্ঠ মশাররফ অকপটে তাঁর ডায়েরিতে লিখে গেছেন, গ্রামের বাড়ি লাহিনীপাড়ায় থাকায় সহজে শহরে যাওয়ার প্রয়োজন বা সুযোগ হত না। কিন্তু যেদিন হাতের কাছের শহর কুষ্টিয়ায় যাওয়া পড়ত সেদিন ছয়মাসের ‘দাদ’ একদিনে তুলে নিতেন, নিজে মজে অবিদ্যাদের মজিয়ে, উৎসবের আনন্দে শহরে অবস্থানের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটিয়ে আসতেন বেশ্যাপাড়ায়। দেশীয় গণিকা শুধু নয়, ‘ইঙ্গ-বঙ্গ বারাঙ্গানা’র প্রতিও হাত বাড়িয়েছিলেন এবং তাঁকে সন্তানও উপহার দিয়েছিলেন। মরমি কবি হাসন রাজার তো হর হামেশাই পতিতা দর্শনে যেতেন।হাসন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার বেশ্যাসক্তির বিবরণ তাঁর সফরভিত্তিক আত্মকথায় মেলে।কবি নজরুল তো কাননবালার ঘরে প্রায় নিয়মিতই যেতেন।কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে পতিতা ও বৈধতাও প্রশ্নহীন নয়।সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তও রক্ষিতা পুষতেন।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের বেশ্যামগ্ন পুরুষের চালচিত্র কেমন ছিল, তার বিবরণ সেকালের অনেক প্রখ্যাত কীর্তিমান মানুষের স্মৃতিচর্চায় পাওয়া যায়। এ থেকে বেশ্যা-সংস্কৃতির সামাজিক চিত্রের নিপুণ পরিচয় পাওয়া যায়। মনীষী রাজনারায়ণ বসু তাঁর “সেকাল আর একাল”-এ লিখেছেন — “এক্ষণকার লোক পানাসক্ত ও পূর্ব্বাপেক্ষা বেশ্যাসক্ত। যেমন — পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি হইতেছে। সে কালে লোকে প্রকাশ্যরূপে বেশ্যা রাখিত। বেশ্যা রাখা বাবুগিরির অঙ্গ বলিয়া পরিগণিত হইত; এক্ষণে তাহা প্রচ্ছন্নভাবে ধারণ করিয়াছে, কিন্তু সেই প্রচ্ছন্নভাবে তাহা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। বেশ্যাগমন বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার প্রমাণ বেশ্যাসংখ্যার বৃদ্ধি। পূর্ব্বে গ্রামের প্রান্তে দুই এক ঘর দৃষ্ট হইত; এক্ষণে পল্লিগ্রামে বেশ্যার সংখ্যা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। এমন কি, স্কুলের বালকদিগের মধ্যেও এই পাপ প্রবলাকার ধারণ করিয়াছে। যেমন পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমন বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহা সভ্যতার চিহ্ন। যতোই সভ্যতা বৃদ্ধি হয় ততোই পানদোষ, লাম্পট্য ও প্রবঞ্চনা তাহার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি হইতে থাকে”।
বেশ্যালয় এবং বেশ্যাবৃত্তি মহানগর, মফস্বল শহর, গঞ্জ ছাড়িয়ে গ্রামীণ জনপদেও প্রসারিত হয়েছিল। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সতীমার মেলায় উল্লেখযোগ্য বেশ্যা-সমাগম হত। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের “সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকার ৪ এপ্রিল সংখ্যায় জানা যায়, সেখানে ‘কুলকামিনী অপেক্ষা বেশ্যাই অধিক’। দীনেন্দ্রকুমার রায় সাক্ষ্য দিয়েছেন, গ্রামীণ মেলা বা আড়ঙে বেশ্যাদের ‘টং’ জাঁকিয়ে বসত। তাদের শিকার ছিল মোহিনী-মায়ায় মুগ্ধ গ্রামের চাষাভূষো ও সাধারণ মানুষ।
উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ” গ্রন্থে কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বিবরণে জানা যায় : “দেওয়ানজী তদানীন্তন কৃষ্ণনগরের যে অবস্থা বর্ণনা করিয়াছেন, তদনুরূপ অবস্থা তখন দেশের অনেক নগরেই বিদ্যমান ছিল। সে সময়ের যশোহর নগরের বিষয়ে এরূপ শুনিয়াছি যে, আদালতের আমলা, মোক্তার প্রভৃতি পদস্থ ব্যক্তিগণ কোনোও নবাগত ভদ্রলোকের নিকটে পরস্পরকে পরিচিত করিয়া দিবার সময়ে — ‘ইনি ইহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকা বাড়ি করিয়া দিয়াছেন, এই বলিয়া পরিচিত করিতেন। রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকাবাড়ি করিয়া দেওয়া একটা মান-সম্ভ্রমের কারণ ছিল। কেবল কি যশোরেই, দেশের সর্ব্বত্রই এই সম্বন্ধে নীতির অবস্থা অতীব শোচনীয় ছিল”।
আঠারো শতকের শেষের দিকে বিশেষ করে বাঙালি সমাজের তলায় যে ঘুণ ধরতে শুরু করেছিল তার একটা কারণ ইংরেজ বণিকদের আনুকূল্যে কিছু মানুষের হঠাৎ করে নবাব হয়ে যাওয়া। মদ্যপান, মেয়েমানুষ রেখে, বেশ্যাবাড়ি গিয়ে, লক্ষ টাকা দিয়ে বেড়ালের বিয়ে দিয়ে, মাইফেলি ও বাইজিদের মুজরা বসিয়ে এঁরা সমাজটাকে পাঁকপূর্ণ করতে চেয়েছিল।১৮৭২ সালে স্থাপিত হল বঙ্গ রঙ্গালয়ের সাধারণ মঞ্চ। শরৎচন্দ্র ঘোষের বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনেত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন একসঙ্গে চার-চারটি বেশ্যানারী। প্রসঙ্গত জানাই, সে সময় ভদ্র সমাজের মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে একসঙ্গে (একা একাও নয়) মঞ্চে অভিনয় করবেন, এটা ভাবাই যেত না। যাই হোক, বাঙলার রঙ্গমঞ্চে প্রথম চার বেশ্যানারীরা হলেন – গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী, জগত্তারিণী এবং শ্যামা।উপেন্দ্রনাথ দাসের “শরৎ-সরোজিনী” নাটকে গোলাপসুন্দরী সুকুমারীর ভূমিকায় এমন প্রাণবন্ত অভিনয় করেছিলেন যে, তিনি ‘সুকুমারী’ নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন। বেশ্যার মেয়ে এবং নিজে বেশ্যা হলেও সুকুমারী স্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে গেলেন উপেন্দ্রনাথ দাসের মধ্যস্থতায় তাঁরই দলের অভিনেতা সুদর্শন গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে বিয়ে হয়ে। পবদিহীন বেশ্যা হয়ে গেলেন মিসেস সুকুমারী দত্ত।এই কারণে গোষ্ঠবিহারী তখন সমাজে পতিত হয়ে গেলেন সত্যই, কিন্তু ভদ্রপল্লিতে সংসার পাতলেন।এইরকম বেশ্যাদের মধ্যে আর-একজন প্রখ্যাত বিনোদিনী, বিনোদিনী দাসী। চৈতন্যলীলায় তিনি নিমাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগান। পরে শ্রী রামকৃষ্ণের স্পর্শে তাঁর ‘চৈতন্য’ হয় বলে কথিত আছে। বর্তমানে স্টার থিয়েটারের নামের সঙ্গে বিনোদিনীর নামও বিজড়িত হয়ে আছে।
১৮২৭ সালে ২৯% থেকে বেড়ে ১৮২৯-এ ৩১%-এ গিয়ে দাঁড়ায়। আর ১৮৬০ সালে দেখা যায় এই মাত্রা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭০%। …..অনেক সৈন্যদের অক্ষম বলে বরখাস্ত করতে হয়। …..বেশ্যাবৃত্তিকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তাই সমস্ত দিক বিচার করে ইংরেজ সরকার ১৮৬৪ সালে পাশ করালেন ‘ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট’(Act XXII of 1864। সেনাছাউনিগুলোতে ইংরেজ সৈন্যদের জন্য তৈরি হল আলাদা বেশ্যালয়, সেখানে যেসব বেশ্যারা আসতেন তাঁদের রেজিস্ট্রিভুক্ত করে পরিচয়পত্র স্বরূপ ‘কার্ড’ দেওয়া হত। যৌনরোগ থেকে তাঁদের মুক্ত রাখার জন্য ‘লক হসপিটাল’ নামে বিশেষ হাসপাতাল স্থাপন করা হয় প্রধান সেনাছাউনিতে সরকারি নির্দেশে পুলিশ লালবাতি এলাকায় বাড়িগুলিতে তল্লাশি চালিয়ে মেয়েদের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে নিয়ে যেত। সামাজিকভাবে সরকারের তাঁদের প্রতি এই ব্যবহার ক্রমশই নৃশংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তার ফলে প্রচুর বেশ্যা কলকাতা ছেড়ে গ্রামে বা অন্য কোথাও পালাতে শুরু করলেন। যাঁরা হাসপাতালে গেলেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ফিরে এসে আর পুরোনো পেশায় ফিরতে সাহস পেলেন না। তাঁদের যেন পেশায় টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছিল। এমনকী শেষপর্যন্ত খদ্দেরদের মধ্যে একটা অংশের অনীহা জন্মাল লালবাতি এলাকায় যাওয়ায়। এত হেনস্থা সহ্য করে তাঁরাও খানিকটা বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন। সব মিলিয়ে ব্রিটিশ সরকার প্রত্যক্ষভাবে না-হলেও পরোক্ষভাবে যেন একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বেশ্যাবৃত্তিকে তুলে দেওয়ার।
চলবে