উপন্যাসঃ নীলকন্ঠী। চতুর্থ পর্ব।
লেখকঃ কাজী খলিলুর রহমান।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে এই গনিকা সমস্যাকে কেন্দ্র করে মূলত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল এই বেশ্যাবৃত্তির এবং বেশ্যাদের দুর্গতির সহমর্মী, যাঁদের মধ্যে সেকালের বিখ্যাত লোকেরা ততটা ছিলেন না, যতটা ছিলেন সাধারণ মানুষ। বিখ্যাত মানুষদের ‘ইমেজ’ রক্ষার দায়বদ্ধতা ছিল বলে তাঁরা প্রকাশ্যে অনেকেই গনিকাদের স্বপক্ষে দাঁড়াতে পারেননি। অন্যদিকে মূল ক্ষমতাকেন্দ্রে বা জ্ঞানচর্চার মূল বৃত্তে বেশ্যাদের বিপক্ষে তৈরি হয়েছিল প্রবল বিরোধ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের দৃষ্টান্তমূলক চিত্র। এখানে সংগঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের প্রচুর নামকরা বুদ্ধিজীবী, মনীষী, সমাজ-সংস্কারক। এঁরা মনে করতেন গনিকাদের বাড়বাড়ন্ত সমাজকে কলুষিত করবে”।
অবশেষে নানা টালমাটাল ও অস্থিরতার পর “গনিকাদের সম্পর্কে নানাধরনের সামাজিক আপত্তির ফলে ১৮৬৮ সালে যে ‘চোদ্দো আইন’-এর প্রবর্তন করা হয়েছিল তাতে ইংরেজ সরকার এদেশীয় ভদ্রলোকদের দাবিকে যে শুধু রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তা নয়, তাঁদের সেনাবাহিনীতে যাতে কোনও বেশ্যা সংসর্গে যৌনরোগের প্রাদুর্ভাব না ঘটে সে বিষয়েও সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে গনিকাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে রেজিস্ট্রি করে পেশা চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারিভাবে গনিকাদের স্বীকৃতি”।
কেমন ছিল সেই কুখ্যাত ‘চোদ্দো আইন’ ? শ্রীগিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কর্তৃক সংগ্রহীত “বেশ্যা গাইড” গ্রন্থে সংকলিত “১৪ আইন” হুবহু তুলে ধরলাম : “(১) ১৮৬৯ সালের ১ লা এপ্রেল তারিখে কিম্বা তাহার পর অবধি কলিকাতায় কিম্বা সহর তলিতে কোন স্ত্রীলোক কিম্বা কোন ব্যক্তি আপন২ বাসস্থান যে থানার অধীন সেই থানায় রেজিষ্টরি না করিয়া গনিকাবৃত্তি এবং বেশ্যালয় রক্ষকের কর্ম্ম করিতে পারিবে না। (২) প্রত্যেক থানায় ইনস্পেক্টর আপন২ থানার এলাকায় যে২ সামান্য গনিকা ও গনিকালয় রক্ষক বাস করে তাহাদের রেজিষ্টরি কার্য্য নির্ব্বাহ করিবেন। (৩) কোন স্ত্রীলোক সামান্য গনিকাবৃত্তি করিতে ইচ্ছা করিলে আপন নাম, বয়স, জাতি বা ধর্ম্ম, জন্মস্থান, বাসস্থান, ও যে সময়ে গণিকাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে এবং যদ্যপি সে কোন গনিকালয়ে বাস করে তাহা হইলে সেই বাটীর কর্ত্তারও রক্ষকের নাম এবং পরে লিখিত জেনরেল রেজিষ্টারি বহিস্থ তাহার নম্বর এই সকল বৃত্তান্ত থানায় নিজে আসিয়া লেখাইতে হইবেক। (৪) থানার ইনস্পেক্টর উক্ত সকল বিবরণ পাইবামাত্র থানায় রেজিষ্টরি বহি (ফারম A) রাখা হইবে সেই বহিবে তাহা লিখিয়া ঐ টিকিট কমিশ্যনার সাহেবের দস্তখতের নিমিত্ত তাহার আপিসে পাঠাইয়া দিবেন। (৫) থানায় রেজিষ্টরি বহির ন্যায় সমুদায় সহর ও সহরতলির জন্য পুলিশ আপীসে যে জেনরেল রেজিষ্টরি বহি রাখা হইবে সেই বহিতে কমিশ্যনার সাহেব ঐ স্ত্রীলোককে রেজিষ্টারি করিবেন, জেনরেল রেজিষ্টরি বহিতে ঐ স্ত্রীলোকের যে নম্বর পড়িবে সেই নম্বর রেজিষ্ট্রেসন টিকিটের প্রথম ঘরে লিখিতে হইবে। ইহা লেখা হইলেই উক্ত টিকিট কমিশ্যনার বা ডিপুটি কমিশ্যনর সাহেবের দ্বারা স্বাক্ষরিত হইয়া থানার ইনস্পেক্টরের নিকট প্ররিত হইবে। ইনস্পেক্টর আপন রেজিষ্টরি বহিতে উক্ত রেজিষ্ট্রেসন টিকিটে লিখিত নম্বর লিখিয়া লইয়া যাহার টিকিট তাহাকে দিবেন। (৬) প্রত্যেক গনিকালয় রক্ষক যে থানার এলাকায় আপন কর্ম্ম চালায় সেই থানায় তাহাকে রেজিষ্টরি করিতে হইবেক আর রেজিষ্টরি করিবার সময় আপন নাম, বাসস্থান এবং যে বাটীতে, কি ঘরে, কি স্থানে, আপনার বৃত্তি চালায় তাহা যে স্থানে থাকে তাহা লেখাইতে হইবেক থানার ইনস্পেকটর উক্ত বিবরণ থানায় যে রেজিষ্টরি বহি (ফারম C) রাখা হইবে সেই বহিতে লিখিয়া লই-বেন। তৎপরে রেজিষ্টরি টিকিট (ফারম D) লিখিয়া ঐ টিকিট কমিশ্যনার সাহেবের দস্তখতের নিমিত্ত তাহার আফিসে পাঠাইয়া দিবেন। (৭) কমিশ্যনার সাহেব তাঁহার আফিসে এক বহিতে প্রত্যেক গনিকালয় রক্ষকের নাম এবং অন্যান্য বৃত্তান্ত লেখাইয়া রাখিবেন। (৮) কমিশ্যনর সাহেবের আফিসের জেনেরেল রেজিষ্টরি বহিতে গনিকালয় রক্ষকদের রেজিষ্ট্রসনের যে নম্বর হইবেক টিকিটেও সেই নম্বর দেওয়া হইবেক, আর ঐ টিকিট কমিশ্যনার কিম্বা ডেপুটী কমিশ্যনার সাহেবের দস্তখত হইলে যে থানার এলাকায় ঐ গনিকালয় রক্ষক আপন বৃত্তি চালাইতে চাহে সেই থানার ইনস্পেক্টরের নিকটে পাঠান হইবেক। (৯) কমিশ্যনর সাহেবের দ্বারা টিকিটে যে নম্বর দেওয়া হইবেক সেই নম্বর ইনস্পেক্টর রেজিষ্টরি বহিতে লিখিয়া যাহার টিকিট তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন। (১০) যদি কোনো স্ত্রীলোক কিম্বা কোন ব্যক্তি পূর্ব্বোক্তমতে রেজিষ্টরি না করিয়া এবং পূর্ব্বমতে রেজিষ্ট্রেসন টিকিট না লইয়া গনিকাবৃত্তি করে কিম্বা গনিকালয় রক্ষকের কর্ম্ম চালায় তাহা হইলে তাহার বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার হইয়া ১৮৬৮ সালের ১৪ আইনমতে বিচার হইবার জন্য ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট সোপরর্দ্ধ হইবেক। (১১) কোন রেজিষ্টরি করা বেশ্যা আপন বাসস্থান পরিবর্ত্তন করিবার ইচ্ছা করিলে তাহাকে কমিশ্যনার বা ডেপুটী কমিশ্যনার সাহেবের সমীপে স্বয়ং কিম্বা ইংরাজি দরখাস্ত দ্বারা যে গলিতে উঠিয়া যাইতে মানস করে তাহার নাম ও নম্বর জানাইতে হইবেক, আর রেজিষ্ট্রেসন টিকিট ফিরাইয়া দিতে হইবেক। যদ্যপি কোন বেশ্যালয়ে থাকিতে মানস করে তবে সেই বেশ্যালয়ের রক্ষকের নাম ও রেজিষ্টেসন নম্বর লেখাইতে হইবেক। (১২) এরূপ দরখাস্ত পাইলে কমিশ্যনার সাহেব রেজিষ্ট্রেসন টিকিটে ও জেনেরেল রেজিষ্টরি বহিতে প্রয়োজনমতে পরিবর্ত্তন করিতে আজ্ঞা দিবেন এবং পূর্ব্বোক্ত টিকিট ঐ স্ত্রীলোককে ফিরাইয়া দিবেন এবং পূর্ব্বে ঐ স্ত্রীলোক যে থানায় রেজিষ্টরি হইয়াছে সেই থানা হইতে তাহার নাম পরিবর্ত্তন করিয়া যে থানার এলাকায় সে উঠিয়া যাইতে মানস করে সেই থানায় তাহাকে পুনরায় রেজিষ্টরি করিতে আদেশ করিবেন। (১৩) কোন বেশ্যা রেজিষ্টার করিয়া অত্র সহরে কিম্বা সহরতলীতে বেশ্যাবৃত্তি ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করিলে তাহাকে স্বয়ং কিম্বা ইংরাজি দরখাস্ত দ্বারা কমিশ্যনার সাহেবকে জানাইতে হইবেক যে তাহার নাম রেজিষ্টরি হইতে উঠাইয়া ফেলা হয় এবং ঐ স্ত্রীলোক যথার্থ বেশ্যাবৃত্তি ত্যাগ করিয়াছে এমত প্রমাণ পাইলে কমিশ্যনার সাহেব তাহার নাম জেনেরল রেজিষ্টর ও থানার রেজিষ্টর হইতে উঠাইয়া দিতে আদেশ করিবেন এবং তাহার রেজিষ্ট্রেসন টিকিট ফিরাইয়া লইবেন। এবং যে পর্যন্ত ঐ দরখাস্তের চূড়ান্ত হুকুম না হয় সে পর্য্যন্ত কমিশ্যনার সাহেব যদি উচিত বিবেচনা করেন তাহা হইলে স্ত্রীলোককে ডাক্তারের পরীক্ষা হইতে মুক্ত করিতে পারিবেক। (১৪) যদি কোন বেশ্যালয়-রক্ষক আপন বাসস্থান কিম্বা ব্যবসার স্থান পরিবর্ত্ত করিতে চাহে তাহা হইলে সে যে স্থানে উঠিয়া যাইবেক তাহার নাম ও নম্বর দিয়া কমিশ্যনার সাহেবের নিকট এক ইংরাজি দরখাস্ত করিতে হইবেক আর সেই দরখাস্তের সহিত রেজিষ্ট্রেসন টিকিট দাখিল করিতে হইবেক”– ইত্যাদি।
দেওয়া হবে না। যে-কোনো যুদ্ধের বাস্তবতা এই যে, যুদ্ধ করেন পুরুষরা। বিজয়ী বা পরাজিত কোনো পক্ষে নারী-যোদ্ধা নেই। যুদ্ধে নারী লুণ্ঠিত হয়, নারী ধর্ষিত হয়, শত্রুপক্ষ যুদ্ধে নারীধর্ষণের তাণ্ডব চালায়। কারণ নারীরা হয় অধিকার স্থাপনের চূড়ান্ত উপায়।যুদ্ধের প্রান্তরে নয়, জয়-পরাজয় নারীর শরীরে হয় নির্ধারিত।ধর্ষণের গল্প বলছি না, বলতে চাই ট্র্যাজেডির কাহিনি। যাঁদের জন্য নারীর সম্মান ধুলিস্যাৎ হল তাঁরাই প্রত্যাখ্যান করল ঘৃণাভরে। সেইসব বীরাঙ্গনা নারীর বেশিরভাগটাই বারপল্লির বারাঙ্গনা হয়েই থেকে যেতে হল।দেশ স্বাধীন হয়ে যায়, সম্মান পায় না ধর্ষিতা বীরাঙ্গনা। মনে রাখতে চায় না কেউ। সমাজ “গনিকা” বলে তিরস্কার করে তাঁদের। অতএব অভাগাদের আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা – গনিকালয়। সমৃদ্ধ হয় গনিকালয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কাজেই তাদের এখন ‘গনিকা’ বললে আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়!
১৯৪৬-এ রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হল, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে ভারতের পাঞ্জাব এবং বাংলা ভেঙে পাকিস্তান হল। লাখো লাখো হত্যার মধ্য দিয়ে দুটি স্বতন্ত্র দেশের নতুন পতাকা উড়ল, লাখো লাখো নারীর ধর্ষণের বিনিময়ে শান্ত দুই যুযুধান সম্প্রদায়।কে মনে রেখেছে তাঁদের কথা, যে মহিলারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার অপরাধে সমাজে ঠাঁই না-হয়ে প্রান্তিক হয়ে গেল ? যুদ্ধ-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-দেশভাগের পরিণতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন মেয়েরা। মেয়েদের দিকেই প্রথম আক্রমণটা নেমে আসে বুলডোজারের মতো। কারণ মেয়েরাই সবচেয়ে নরম শিকার — জাতে মারা যায়, ধর্মনাশ করা যায়। গননিকালয় গুলি ভরে ওঠে।
(৩) উপনিবেশের ফলে গনিকা : শুধু ভারতবর্ষই নয়, পৃথিবীর এমন কোনো অবশিষ্ট দেশ নেই, যে দেশ কোনো-না-কোনো লুটেরা দ্বারা উপনিবেশ হয়নি। বিশেষ করে যদি ভারতের কথাই ধরি, তাহলে বলা যায় – সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোধহয় ভারতই ধর্ষিত হয়েছে। প্রাচীন যুগের আর্য আগমন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ব্রিটিশ আগমন পর্যন্ত – সর্বযুগে যুগান্তরে ধর্ষিত হয়েছে নারী, লুণ্ঠিত হয়েছে নারী। নারী অপহরণ আর ধর্ষণের মধ্য দিয়ে স্থানীয় প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা বা জব্দ করেছে আক্রমণকারী প্রতিপক্ষ।স্থানীয় প্রতিপক্ষকে বশে আনতে ধনসম্পদ করায়ত্ত এবং নারী অপহরণ হারেম ভরানোই ছিল আক্রমণকারী প্রতিপক্ষের প্রধান কৌশল। সময়ের পথ ধরে ইতিহাসের নানা চড়াই-উতড়াই অতিক্রম করে অখণ্ড ভারত উপমহাদেশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে তৈরি হয়েছে আজকের ভারত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ।মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে বিদেশি শক্তির আগ্রাসন, পরাধীনতা এবং সাম্রাজ্যবাদ।লুণ্ঠিত হয়েছে নারী, বারবার। নারী ধর্ষিতা হয়েছে অত্যন্ত নির্দয়তায়।ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে গনিকাবৃত্তির অন্ধকার গলিতে।
(৪) পর্নোছবির গনিকা : পর্নোগনিকামি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে নারী ও শিশুদেহের বাণিজ্যিক ব্যবহারের আর-এক ভয়াবহ রূপ পর্নোগ্রাফি। এর চর্চা আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে গোটা পৃথিবীব্যাপী মহামারীর রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ খাতটিরও অর্থনৈতিক বাজার অনেক বড়ো, অর্থাৎ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। বিশ্বখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও আইনজীবী ক্যাথরিন ম্যাককিননের মতে, পর্নোগ্রাফি শিল্প হিসেবে হলিউডের চেয়ে অনেক বড়ো। স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যার দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট কানেকশন এখন আর বিস্ময়কর কিছু না। চাইলেই তারা সেক্স সাইট ব্রাউজ করতে পারছে, ডাউনলোড করে নিতে পারছে যে-কোনো পরিমাণ পর্নো ফুটেজ। যাদের ঘরে সে সুবিধে নেই তাদের জন্য রয়েছে অলিতেগলিতে গজিয়ে ওঠা সাইবার ক্যাফে। এক ঘণ্টা ব্রাউজ করার জন্য ক্যাফেগুলোতে চার্জ নেয়া হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং এর বিনিময়ে একটিমাত্র ক্লিকেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভারচুয়াল যৌনমিলনের জগতে।পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যারা যৌনসঙ্গম করে তারাও আর-এক ধরনের গনিকামি করে থাকে।এ ধরনের গনিকামি ভারত-বাংলাদেশসহ প্রায় সব বিশ্বেই নির্মাণ হয়ে থাকে। কোথাও গোপনে, আবার কোথাও ওপেনে। আমেরিকায় পর্নো-ইন্ডাস্ট্রি রাষ্ট্র-স্বীকৃত। বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মহিলারা পর্নোফ্লিমে অংশগ্রহণ করেন মোটা টাকা রোজগারের কারণে। পর্নো ইন্ডাস্ট্রিতে অসংখ্য মহিলারা প্ররোচনার শিকার হয় নিশ্চয়, একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। একইভাবে অসংখ্য মহিলা মোটা টাকা রোজগারের টানে চোখ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা বিশ্বে কত রেভিনিউ আদায় হয় এই সেক্স-অ্যাডভেঞ্চার থেকে ?
বলেন, যৌনকর্মীদের পরিচয় দেওয়ার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়, যে শব্দ ওই নায়িকাদের জন্য তো ব্যবহৃত হয় না ? রেখা রানি বলেন, শরীরের বিনিময়ে নায়িকা হওয়াও তো সেক্স ওয়ার্কারের মতো কাজ। আমরাও তো সেক্স করে উপার্জন করি। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কেন অন্য রকমের আচরণ করা হবে ? নায়িকা হওয়ার জন্য সেক্স করতে হয়, আর আমরাও পেট চালাতে সেক্স করি। দুই ক্ষেত্রই তো একই রকমের। তাহলে কেন আমাদের প্রতি অন্য রকমের ব্যবহার করা হবে? মহারাষ্ট্রের নাসিকের যৌনকর্মীদের সংগঠন দিশা মহিলা বহুউদ্দেশীয় সংগঠনের সচিব তথা এআইএনএসডব্লু-র অপর যুগ্ম সচিব লতা কাপসে বলেন, শরীর বিক্রি করে নায়িকা হলেও সেক্ষেত্রে সেক্স ওয়ার্কার বলা হয় না। আর আমরা শরীরের বিনিময়ে বেঁচে থাকলেও আমাদের সেক্স ওয়ার্কার বলা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অসম্মানিত করা হয়।
(৬) শিল্পের ক্যানভাসে গনিকা : ‘রং রসিয়া’ মুভিতে দেখানো হয়েছে চিত্রশিল্পী রবি ভার্মার চিত্রশিল্পের মডেল সুগন্ধিকে, যিনি চিত্রশিল্পীর চিত্রশিল্পের জন্য নগ্ন হতেন এবং কখনো-সখনো চিত্রশিল্পীর সঙ্গে যৌনমিলনও করতেন। সুগন্ধি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি শিল্প এবং প্রেমের জন্য নগ্ন হলেও রবি ভার্মা, রক্ষণশীল সমাজ, রাষ্ট্র তাঁকে ‘গনিকা’ হিসাবেই দেখত।স্বীকৃতিহীন এক নারী সুগন্ধির পরিণতি হল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা। চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকবেন, ভাস্কররা ভাস্কর্য গড়বেন – এ তো খুব সুখের ব্যাপার। শিল্প মনের বিকাশ ঘটায়, চেতনার মুক্তি দেয়। তাই বলে কথায় কথায় নগ্ন নারী কেন, নারীর শরীর কেন ?
ঠিক কবে থেকে শিল্পীদের নগ্ন নারী প্রয়োজন হয়েছিল তা ঠিকঠাক সাল-তারিখ জানা না-গেলেও একথা বলাই যায়, পুরুষ-পরিচালিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষরা নারীদের নগ্ন করতে নগ্ন দেখতে নানা অছিলায় লালায়িত ছিল। শুধু ছিল বলব কেন? আছে এবং থাকবে যতদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থাকবে। নগ্নচর্চা শুরু হয়ছে সম্ভবত রাজাদের ইচ্ছাপূরণে শিল্পীদের নিয়োগে। রাজারা নগ্নতা খুব পছন্দ করতেন। তাঁরা আদিরসাত্মক কাহিনি পছন্দ করতেন বলেই প্রাচীন সাহিত্য রগরগে যৌনকাহিনিতে ভরপুর। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, সংস্কৃত সাহিত্যে আদিরসাত্মক এতটাই যে, মূল ভাষার কাহিনি অপ্রাপ্তবয়স্কদের পাঠ করা নিষিদ্ধই।শুধু অক্ষর-লেখনিতেই নয়, তুলিতে-ছেনিতেও নারীকে নগ্ন করার প্রয়াস শুরু হয়েছিল। সমালোচনার ঝড় এড়াতে মাহাত্ম্য জুড়ে দেওয়া হল শিল্পের নামে। শিল্প, তাই নারীকে যত খুশি নগ্ন করো আর সামনে বসাও, শোয়াও এবং দাঁড় করাও।নারীর নগ্নতা কি শুধু শিল্পই?