
পৃথিবীর প্রথম সফল যন্ত্র প্রকৌশলীঃ
আল জাজারি (১১৩৬-১২০৬ খ্রিস্টাব্দ)
- মোঃ মাজহারুল ইসলাম
বদি উজ-জামান আবু ইবনে ইসমাইল ইবনে আর রাজ্জাক আল জাজারি, সংক্ষেপে ইসমাইল আল জাজারি সম্ভবত ১১৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর্তুকিদ নামক এক প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি, যা বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্গত। জন্মস্থানেই সম্ভবত ১২০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন আল জাজারি। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এর বেশি কিছুই জানা যায় না।
আল জাজারির কিছু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বা অটোম্যাটার নমুনা দেখলে বিস্ময়ে আপনার চোখ কপালে ওঠার যোগাড় হবে। সংক্ষেপে সেগুলোর পরিচয় দিচ্ছি-
[১] হাইড্রোপাওয়ার চালিত পৃথিবীর প্রথম দিকের একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা তৈরি করেন জাজারি।
[২] আধুনিককালের ঘড়িতে যেরকম নির্দিষ্ট সময়ে ঘন্টা দেয়ার জন্য একধরনের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে যায়, যা থেকে কোনো পাখি বা বিশেষ বস্তু বেরিয়ে আসে, জাজারি নিজের তৈরি একটি জলঘড়িতে এমন স্বয়ংক্রিয় দরজা ব্যবহার করেছিলেন।
[৩] বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে মানুষের বদলে রোবট ওয়েটারের ব্যবহার শুরু হয়েছে। যদি বলি, বিশ্বের প্রথম রোবট ওয়েটারটি আল জাজারি তৈরি করেছিলেন! গঠনে, যান্ত্রিক কৌশলে অনেক পিছিয়ে থাকলেও জাজারির চিন্তাভাবনা ছিল বিস্ময়করভাবে অগ্রসর। অবশ্য জাজারি ওয়েটার নয়, ওয়েট্রেস বা পরিচারিকা তৈরি করেছিলেন। তার পরিচারিকাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চা, পানি কিংবা মদ পরিবেশন করতে পারতো। একটি মাঝারি আকৃতির ট্যাংকের মধ্যে থাকতে পানীয় যা ফোঁটায় ফোঁটায় প্রতি সাত মিনিটে নির্দিষ্ট পাত্র বা পেয়ালায় জমা হতো। এরপর সেটি একটি স্বয়ংক্রিয় দরজার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পরিবেশন করতো সে পানীয়!
[৪] পৃথিবীর প্রথম ফ্লাশ টয়লেটের ধারণাও আসে তারই একটি আবিষ্কার থেকে।
[৫] হাত ধোয়ার জন্য একটি অত্যন্ত শৌখিন যন্ত্র তৈরি করেন আল জাজারি, যা আজকের পৃথিবীতে বসেও ভীষণ রকমের শৌখিনই মনে হবে। ‘পিকক ফাউন্টেইন’ নামক যন্ত্রটি এরূপ- দেয়ালের মধ্যে একটি যান্ত্রিক ময়ূর স্থাপিত, যার লেজে রয়েছে একটি প্লাগ। এই প্লাগ টানলেই ময়ূরের ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে পানি! পানিতে আপনি হাত ভিজিয়ে নিতে নিতে আরেকটি প্লাগ টানুন, ময়ূরের নিচ থেকে এবার একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গিয়ে আপনার জন্য সাবান উপস্থিত হবে। সাবান মাখিয়ে হাত ভালোমতো ধুয়ে পুনর্বার আরেকটি প্লাগ টানুন, বেরিয়ে আসবে তোয়ালে!
[৬] অটোম্যাটেড ময়ূর থেকেও আরো বিস্ময়কর যন্ত্র তৈরি করেছেন আল জাজারি। আর তা হচ্ছে ‘মিউজিক্যাল অটোম্যাট’ বা একটি রোবটের ব্যান্ডদল! মোটেও ভুল কিছু পড়ছেন না পাঠক, রাজকীয় কোনো অনুষ্ঠানে অতিথিদের বিনোদিত করার জন্য জাজারি তৈরি করেন একটি রোবট ব্যান্ড। একটি ছোট নৌকার উপর বসানো থাকে চারজন কৃত্রিম সঙ্গীতজ্ঞ। নৌকাটি লেকে ছেড়ে দেয়া হলে তা লেকের ঢেউয়ের সাথে দুলতে থাকে এবং ছন্দময় সুরের সৃষ্টি করে সেই চার বাদক!
[৭] আল জাজারির সবচেয়ে চমৎকার নির্মাণ হচ্ছে তার ‘ক্যাসেল ক্লক’। ৩.৪ মিটার উচ্চতার এই বিশাল ঘড়ির কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
ক) ঘড়িটি রাশিচক্রের বিশাল এক নকশা উপস্থাপন করে।
খ) চাঁদ, সূর্যের আবর্তন কক্ষপথ নির্দেশক রয়েছে।
গ) দিন-রাতের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঘড়িতে সময় পরিবর্তন করা যায়।
ঘ) ডিজিটাল ঘড়ির মতো এই ঘড়িতেও ছিল অ্যালার্ম ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট সময় পর বাদ্য বাজাতে শুরু করতো ঘড়ির নিচে অবস্থিত একদল কৃত্রিম বাদক।
[৮] পেন্ডুলাম ঘড়িতে পেন্ডুলামের দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য চমৎকার এক যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করা হয়, যার নাম ‘এস্কেপম্যান্ট অ্যাংকর’। আল জাজারি এই এস্কেপম্যান্টের কৌশল কাজে লাগিয়ে চাকার গতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের যান্ত্রিক কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেন! আধুনিককালের গাড়ির ব্রেকের ধারণার একটি প্রাথমিক রূপ ছিল জাজারির আবিষ্কার!
[৯] ১২০৬ সালে আল জাজারি আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার জন্য অমূল্য এক যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি একটি বিশেষ পানি শোষক যন্ত্র তৈরি করেন, যার মধ্যে প্রথমবারের মতো ‘ডাবল অ্যাকশন’ কৌশল ব্যবহার করা হয়। এই পাম্পেও তিনি ক্র্যাংক শ্যাফট ব্যবহার করেছেন। শ্যাফটের দু’পাশে দুটি সিলিন্ডার বসিয়ে তিনি তার চিন্তার অগ্রসরতার ছাপ রেখেছেন এই যন্ত্রে। আরো একাধিক কারণে জাজারির ডাবল অ্যাকশন পাম্পটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রকাশকঃ সবুজ হুসাইন।
সম্পাদকঃ মোঃ ইমদাদুল হক নয়ন।