হারানো বন্ধুত্বের পুনর্জন্ম: এক মর্মস্পর্শী গল্প
কিছু সম্পর্ক সময়ের ধুলোয় ঢাকা পড়ে গেলেও তার গভীরতা কখনও ম্লান হয় না। আমার জীবনে এমন দু-তিনজন কাছের বন্ধুর মধ্যে অন্যতম হলো আজাদ, যার পুরো নাম ডি.এম আজাদ হোসেন। সে শুধু একজন বন্ধু নয়, আমার শৈশবের রঙিন স্মৃতি আর হারানো দিনের প্রতিচ্ছবি।
আজাদের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই প্রাইমারি স্কুলের আঙিনায়। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণী থেকে শুরু করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত আমরা ছিলাম অবিচ্ছেদ্য অংশ। নওগাঁ সদর হাসপাতালে আজাদের বাবার চাকরির সুবাদে ওরা হাসপাতাল রোডের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকত। সেই স্টাফ কোয়ার্টারের প্রতিটি ইঁট যেন আজও আমার কানে ফিসফিস করে বলে যায় অজস্র গল্প। আমি, আজাদ আর আমাদের আরেক বন্ধু শাওন – এই ত্রয়ী ছিল খেলার মাঠে, বইয়ের পাতায় আর দুরন্ত শৈশবের প্রতিটি পদক্ষেপে একসঙ্গে।
শাওনের বাড়ি ছিল যেন এক জ্ঞানভাণ্ডার। অসংখ্য বইয়ের সংগ্রহ থেকে শাওন প্রায়শই আমাদের দিত রোমেনা আফাজের বিখ্যাত ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ কিংবা কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’র রোমাঞ্চকর জগৎ। সেই বইগুলো পড়ার পর আজাদদের বাড়িতে বিনিময় করতে যাওয়া ছিল এক নিত্যদিনের অভ্যাস। খালাম্মা আর খালুজানের অপার স্নেহ আর ভালোবাসায় সেই বাড়িটা ছিল আমার দ্বিতীয় ঠিকানা। ছেলেবেলার কোনো ঈদ এমন যায়নি যখন আজাদের বাড়িতে খালাম্মার হাতের বানানো লাচ্ছা সেমাই আমার পেটে পড়েনি।
কিন্তু অদ্ভুত এক হীনমন্যতা আমাকে গ্রাস করে রেখেছিল। আজাদের মতো একজন বন্ধুকে কখনও নিজের বাড়িতে আনার সাহস পাইনি। আমাদের বাড়ির পরিবেশ এতটাই সাধারণ ছিল যে, বন্ধুর সামনে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাকে কখনও আমন্ত্রণ জানাইনি। সেই কষ্ট আজও আমার হৃদয়কে বিদ্ধ করে। আজাদ যখন স্কুলে আসতো, তার ছোট ভাই সাজুকে সঙ্গে নিয়ে আসতো। সাজুর স্বাস্থ্যবান শরীর টসটসে গাল আর সরল হাসি দেখলে মনে হতো যেন সে আমারই আপন ছোট ভাই। আমার কোনো ভাই না থাকার শূন্যতা যেন সাজুর উপস্থিতি পূর্ণ করত।
জীবনের মোড় ঘুরে গেল দ্রুতই। নওগাঁ শহরের দেয়ালের মোড়ে আমাদের বাড়ি খিদিরপুরে স্থানান্তরিত হলো, আর এর কিছুদিন পরেই আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। আজাদের সঙ্গে তৈরি হলো এক অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব। চাকরির সূত্রে প্রথমে রাজশাহী, তারপর ঢাকায় চলে আসার পর আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করত, এক ভিন্ন রকমের শূন্যতা বিরাজ করত প্রতিনিয়ত। ছুটির সময় যখনই বাড়িতে যেতাম, আজাদের খোঁজ নিতাম পরিচিতজনদের কাছে। কিন্তু কেউই তার সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারত না। যখনই হাসপাতাল রোডের পাশ দিয়ে যেতাম, উঁকি মেরে এক সময়ের স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে তাকিয়ে চিনবার চেষ্টা করতাম আজাদের বাড়িটা। বারবার মনে হতো দরজার দিকে এগিয়ে যাই, কিন্তু অদৃশ্য এক বাধা যেন পথ আটকে দিত। মনের মধ্যে রাজ্যের দ্বিধা বাসা বাঁধত – “আজাদ কি আমাকে সেভাবে মনে রেখেছে?” এই দ্বিধা আর সংকোচেই আর কখনও সেদিকে যাওয়া হয়নি।
এভাবেই কেটে গেল অনেক বছর। জীবনের গতিপথে অজস্র পরিবর্তন এল, অনেক ঘটনার আড়ালে আজাদ চাপা পড়ে গেল। কিন্তু হৃদয়ের এক বিশেষ জায়গায় তার জন্য রক্তক্ষরণ কখনও থামেনি। যখন ফেসবুক ব্যবহার শুরু করলাম, কতবার যে “আজাদ হোসেন” লিখে সার্চ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। অসংখ্য আজাদের মুখ দেখলেও আমার কাঙ্ক্ষিত আজাদকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবুও হাল ছাড়িনি।
একদিন ফেসবুকের একটি বিশেষ কুইজে অংশ নিয়েছিলাম, যেখানে প্রশ্ন ছিল – “জীবনে এমন কোন হারানো বন্ধুর নাম লিখুন যাকে আপনি আজও খুঁজে পাননি?” দ্বিধাহীন চিত্তে সেদিন লিখেছিলাম – “ডি,এম আজাদ হোসেন”। অবিশ্বাস্যভাবে, আমি জানি না কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, এর কিছুদিন পরেই আমার ফেসবুক টাইমলাইনে ‘People You May Know’ সেকশনে ভেসে উঠল একটি অতি পরিচিত তবে বদলে যাওয়া মুখ। আমার মন সায় দিল – “এটাই আজাদ!” তৎক্ষণাৎ একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে তার ইনবক্সে লিখলাম – “আপনি কি সেই আজাদ হোসেন? যার বাবার নাম মোঃ আনোয়ার হোসেন? যার সাজু নামের একটি ছোট্ট ভাই ছিল? যারা একসময় হাসপাতাল রোডের স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাস করত? যার বিপুল নামে একটি বন্ধু ছিল?”
তাৎক্ষণিক ফিরতি মেসেজ এল – “হ্যাঁ রে বন্ধু, আমি সেই আজাদ!” “তুই কেমন আছিস…..?”
বিশ্বাস করুন, আবেগে সেদিন আমার চোখে জল চলে এসেছিল। আজাদ ম্যাসেঞ্জারে সরাসরি অডিও কল দিল, কিন্তু সেদিন আমি এতটাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলাম যে কলটা রিসিভ করতে পারিনি। একটু ধাতস্থ হলে আমি পুনরায় কল দিলাম। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম কথা….! বুকের মধ্যে চেপে রাখা অসংখ্য কথা যেন একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইলো। অথচ মুখে কোন কথাই উচ্চারণ করতে পারছিলাম না! হয়তো ওর অবস্থাও এমন!
সেই দিনের পর থেকে ইন্টারনেট আর প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের স্কুল জীবনের হারানো সব বন্ধুকে একে একে ফিরে পেলাম। আজ আমাদের ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে দুটি গ্রুপ রয়েছে, যেখানে আমরা প্রায়শই ভিডিও চ্যাটিংয়ে একত্রিত হই। আমরা একবার “আয় রে.. মিশি প্রাণের টানে” শীর্ষক একটি মিলন মেলার আয়োজন করেছিলাম। সবাই এখন একসঙ্গে রয়েছি, যেন সময়ের ব্যবধান শুধুই একটি মায়া। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে একটাই চাওয়া – আমাদের এই বন্ধুত্ব যেন আজীবন টিকে থাকে, যেমনটা শৈশবের সেই নির্বাক ভালোবাসা আজও আমার হৃদয়ে জীবন্ত।
~@বিপুল..…
