
গল্পের নাম: "ভোরের আগে"
লেখক: মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌺
ধরন: ইসলামিক নৈতিক গল্প
উৎস: সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত তিন যুবকের গুহার কাহিনী
১.পাহাড়ি সন্ধ্যা
পাহাড় ঘেরা ছোট্ট এক গ্রাম। সেখানেই বাস করত যুবক সালেহ। তিনি একজন মেষপালক, প্রতিদিন সূর্য ডোবার আগেই মেষ চড়াতে যেতেন আর সন্ধ্যায় ফিরে আসতেন মা-বাবার জন্য দুধ নিয়ে। তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবা — দুজনেই দুর্বল ও অন্ধ। সালেহ তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ ভালোবাসা দিতেন তাঁদেরই জন্য।
মা-বাবা প্রতিদিন তাঁর অপেক্ষায় থাকতেন। তিনি ফিরলেই দুধের পাত্রটি তাঁদের ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিতেন। তারপর বাকি দুধ দিতেন তাঁর স্ত্রী আর সন্তানদের।
২.এক দুর্ভাগ্য রাত্রি
একদিন দূরের এক উপত্যকায় মেষ নিয়ে গিয়ে ফেরার পথে বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হলো। পাহাড়ি নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। পথঘাট অন্ধকার আর পিচ্ছিল। সালেহ প্রাণপণ চেষ্টা করেও রাত গভীর হওয়ার আগে বাড়ি পৌঁছাতে পারলেন না।
বাড়ি ফিরলেন যখন, তখন মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর পিতার বুকের হাঁপানি আর মায়ের মুখের শান্ত নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছিল তাঁরা কতটা ক্লান্ত।
কিন্তু... সালেহ তাঁদের ঘুম ভাঙালেন না। হাতে ধরা দুধের পাত্রটি ঠিক আগের মতো ধরে রাখলেন। সন্তানরা পেটের ক্ষুধায় কাঁদছিল, স্ত্রী জিজ্ঞেস করছিল, “তুমি কি পাগল হলে? সন্তানদের আগে না খাইয়ে মা-বাবার ঘুমের অপেক্ষা করছো?”
সালেহ ধৈর্য ধরলেন। হৃদয় কাঁদছিল, চোখ জ্বলছিল, তবুও দাঁড়িয়ে রইলেন ভোর পর্যন্ত।
৩.ভোরের আলো, হৃদয়ের প্রশান্তি
শেষ পর্যন্ত মা-বাবা ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। সালেহ ধীরে ধীরে তাঁদের ঠোঁটে দুধের পাত্রটি ধরলেন। তাঁরা তৃপ্তির সাথে পান করলেন, সালেহ নিঃশ্বাস ফেললেন — যেন একটি যুদ্ধ জয় করে ফিরলেন।
তিনি রাতের ঐ পরীক্ষাকে কখনো ভুলেননি।
৪.একদিন পাহাড়ে
বছর কয়েক পরে সালেহ বন্ধুদের সাথে এক পাহাড়ি সফরে বের হলেন। হঠাৎ এক প্রবল ঝড়ে এক বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়ল এবং তারা তিনজন আটকে গেলেন গুহার ভিতর। বাইরে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। হতাশা, ভয় আর মৃত্যু তাদের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
তখন সালেহ বললেন, “আমরা আমাদের জীবনের কোন এক আমল যদি একান্তই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে এখন সেই আমল স্মরণ করে দো‘আ করি।”
৫.ভালোবাসা, যে পাহাড় সরাতে পারে
সালেহ বললেন,
“হে আল্লাহ! আপনি জানেন, এক রাতে আমি আমার মা-বাবার জন্য দুধ নিয়ে ফিরি। কিন্তু তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। আমি তাদের ঘুম ভাঙাতে চাইনি। আমার স্ত্রী-পুত্র ক্ষুধায় কাঁদছিল, তবুও আমি অপেক্ষা করেছিলাম যতক্ষণ না তারা নিজেরা জেগে উঠে পান করেন। আমি তা করেছিলাম কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্য। হে আল্লাহ! যদি এ কাজ আপনার সন্তুষ্টির জন্য হয়ে থাকে, তবে আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করুন।”
সাথে সাথে সেই পাথর একটু সরে গেল। আলো গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল, আকাশ দেখা গেল।
৬.
শেষ কথা
মায়ের প্রতি ভালোবাসা কখনো বৃথা যায় না। এক কাপ দুধ, এক রাতের অপেক্ষা — একদিন মৃত্যুর মুখ থেকে মুক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
📖 উপকারিতা:
এই গল্পটি আমাদের শিক্ষা দেয় —
✓মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা এমন এক ইবাদত, যা আল্লাহর নিকট কবুল হলে পাহাড়ও সরতে পারে।
✓সন্তানদের ক্ষুধা, স্ত্রীর দুঃখ — সব কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল সালেহর আল্লাহভীতির এক দৃষ্টান্ত।
✓ইখলাস (আল্লাহর জন্য কাজ করা) হলো এমন এক সম্পদ, যা বিপদের গভীর অন্ধকারেও আলো আনতে পারে।
হাদীস উৎস: সহীহ বুখারী (হাদীস ৫৯৭৪), সহীহ মুসলিম (হাদীস ২৭৪৩)
মূল বক্তব্য: তিন ব্যক্তি এক গুহায় আশ্রয় নেয়, আর প্রত্যেকে তাদের একটি আমল উল্লেখ করে আল্লাহর নিকট মুক্তি চায়। সালেহর দো‘আ ছিল — মায়ের প্রতি ভালোবাসা।
প্রকাশকঃ সবুজ হুসাইন।
সম্পাদকঃ মোঃ ইমদাদুল হক নয়ন।