নওগাঁ নামের আমার ছেলেবেলার ছোট্ট শহরটিকে মাঝখান থেকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে আত্রাই নদী। এই নদীরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে, আমার শৈশবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে এক খাল—স্থানীয় ভাষায় যাকে আমরা “ডাঁড়া” বলে ডাকি, যার আসল নাম শুঁয়োরমারী খাল। এই খাল শুধু একটি জলধারা ছিল না, ছিল আমার শৈশবের স্মৃতির এক জীবন্ত ক্যানভাস।
আত্রাই নদীর প্রাণবন্ত জলের ধারা থেকে ফসলের ক্ষেত সিক্ত করার উদ্দেশ্যে শহরের আনাচে-কানাচে খনন করা হয়েছিল অসংখ্য খাল, যা বিলের দিকে ধাবিত হতো। সেই খালগুলোরই একটি ছিল এই শুঁয়োরমারী খাল। নামের মতই অদ্ভুত তার গতিপথ! আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলতো সে, প্রতিটি বাঁকে যেন সে তার বিস্তার আর গভীরতা বাড়তো । ঠিক সেই বাঁকগুলিরই এক পাশে, আত্রাই নদীর তীর হতে বিলের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে, (চকএনায়েত) আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছে।
সারা বছরই ডাঁড়ায় কমবেশি পানি থাকতো। কখনো শান্ত, কখনো বা উচ্ছল স্রোতধারায় মুখরিত। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা এর কয়েকটি জায়গায় ঝুলন্ত পায়খানা তৈরি করে এর পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছিল। সত্যি কথা বলতে কি সে দলে আমরাও ছিলাম। ঝুলন্ত এই পায়খানা গুলির কারণেই মানুষ চলাফেরার সময় এই এলাকাটিকে এড়িয়ে চলত। যে দুই একজন চলতো তারাও নাক ধরে যেতে বাধ্য হত।
যাহোক বর্ষাকালে যখন আত্রাই নদী উপচে পড়ার উপক্রম হতো, তখন যেন ডাঁড়া হয়ে উঠতো এক ত্রাণকর্তা। নদীর বাঁধ রক্ষা করতে এর কিছু পানি এই খাল দিয়েই বিলের দিকে প্রবাহিত হতো। সেই অবিরাম জলধারা যখন ডাঁড়া দিয়ে বিলের দিকে ছুটতো, তখন খালের দুই পাড়ে জমে থাকা মানুষের জঞ্জাল বাধা সৃষ্টি করতো, আর মুহূর্তেই প্লাবিত হয়ে যেত আশেপাশের এলাকা।
স্কুলে যাওয়ার পথে খালপাড়ের রাস্তাটা শুকনো দেখতাম, আর স্কুল থেকে ফিরে হয়তো দেখতাম হাঁটু অবধি পানি। তখন মনটা আনন্দে নেচে উঠতো! সেই হাঁটু পানিতে গড়াগড়ি করে গোসল করার চেষ্টা করতাম আমরা, আর বড়রা তো ঝাঁপিয়ে পড়তো সাঁতারে, মেতে উঠতো হইহুল্লোড়ে। কখনো কখনো অতি উৎসাহী কাউকে জাল ফেলে মাছ ধরতেও দেখতাম। পুরো বিল যখন পানিতে থৈ থৈ করতো, তখন ডাঁড়ায় তৈরি হতো বিপরীতমুখী স্রোত, আর তখনই খালের আশপাশের এলাকা তলিয়ে যেত বন্যার জলে। কখনো কখনো এই জলমগ্নতা এক থেকে দেড় মাসও স্থায়ী হতো। মাটির ঘরগুলো তখন পানির সংস্পর্শে এসে ধসে পড়ার উপক্রম হতো, আর এর বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যেত আশপাশের স্কুলগুলোতে। কারণ বন্যার কারণে শহরের স্কুলগুলো ঐ সময় বন্ধ থাকতো।
এমন অভিজ্ঞতা আমারও কয়েকবার হয়েছিল। একবার গিয়েছিলাম চকএনায়েত উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনে। সেখানে আগেই অনেক মানুষ উপস্থিত হওয়ায় আমরা কোনো শ্রেণীকক্ষের ভেতরে জায়গা পাইনি, বারান্দাতেই আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স মাত্র আট বছর। স্পষ্ট মনে আছে, সারারাত বৃষ্টির পানিতে ভিজে পরদিন সকালে আব্বা আমাদেরকে নওগাঁ জিলা স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন। এখানেও অসংখ্য পরিবার এসেছিল। পূর্বের মতো এখানেও আমরা শ্রেণীকক্ষে স্থান পেলাম না, বারান্দাতেই আমাদের আশ্রয় নিতে হলো।
সাথে আনা অল্প কিছু সরঞ্জাম দিয়েই আব্বা আর মাকে এখানেই সংসার পাততে দেখলাম। মা তার ব্যবহৃত শাড়িগুলো দেয়ালের পোঁতা পেরেকের সঙ্গে বেঁধে ছোটখাটো একটি ঘরের মতো তৈরি করলেন। সেখানেই মাদুর পেতে, উত্তরের দেয়াল বরাবর দুটো বালিশ রেখে শোয়ার ব্যবস্থা হলো। বাবা হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়া মাঠ পেরিয়ে লম্বা লম্বা ধাপ ফেলে দোকান থেকে শুকনো খাবার নিয়ে এলেন। নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে প্রথমে আমার বেশ আনন্দ লাগছিল।
কিন্তু আমার এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অল্প কিছুক্ষণ পরেই এখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতি বুঝতে পারলাম। স্কুলটির পুরো মাঠ হাঁটু পানিতে ডুবে গেছে, আর এই কারণেই মাঠের ঘাসের নিচে, মাটির নিচে বসবাস করা অসংখ্য কেঁচো শুকনো জায়গার খোঁজে স্কুলের বারান্দার দিকে উঠে আসতে লাগলো। কোনোটির আকৃতি ছিল আধ হাত, কোনোটির প্রায় এক হাত লম্বা। প্রচণ্ড গতিতে এদের উঠে আসতে দেখে আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। মা কোথা থেকে যেন একটি নারকেলের ঝাড়ু সংগ্রহ করে এনে প্রাণপণে সেগুলোকে ঝাড়ু দিয়ে বারান্দার নিচে নামিয়ে দিতে লাগলেন। আমি অবিশ্বাসভরা চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম মা বারান্দার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঝাড়ু দিয়ে সামনে যান, ততক্ষণে পেছনে আবার কেঁচোগুলো উঠে এসে বারান্দা ভরে যায়। মা আবার বিপরীত দিক থেকে ঝাড়ু দেওয়া শুরু করেন। এভাবে অনবরত চলতে থাকে। ততক্ষণে আমার ভয় কিছুটা কমে, আমি নিজেও মার সঙ্গে যোগ দিই।
বাবা বললেন, “দুশ্চিন্তায় এভাবে তো এখানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। দিনে না হয় কোনোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া গেল, কিন্তু রাতের বেলা ঘুমিয়ে থাকলে সে সময় ওরা যদি এভাবে উঠে আসতে থাকে তখন কী অবস্থা হবে?” অগত্যা আমাদেরকে আবারও স্থান পরিবর্তন করতে হলো।
এবারে আমাদের নতুন ঠিকানা হলো পুরনো জেলখানার কাছাকাছি অবস্থিত নওগাঁ সরকারি কে ডি স্কুল। এই স্কুলটি শহরের ভেতরের দিকে অবস্থিত হওয়ায় এখানে লোক সমাগম অনেক কম হয়েছিল। আমরা একটি শ্রেণীকক্ষের ভেতরে সুবিধামত জায়গায় অনেকগুলো সিট-বেঞ্চ একত্রিত করে চৌকির মতো তৈরি করে সেখানে কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে রীতিমতো রাজকীয় বাসস্থান তৈরি করে নিলাম। বিকেলের শেষের দিকে একদল মানুষ এসে কিছু শুকনো খাবার দিয়ে গেল, সম্ভবত এগুলো সরকারি অনুদান ছিল। দিনভর বন্যা, বৃষ্টির জলে আর প্রকৃতির সাথে বাসস্থানের জন্য অসাধারণ যুদ্ধের পর আমাদের থাকা এবং খাওয়ার জন্য একটি পোক্ত ব্যবস্থা হলো।
ওই স্কুলে আমরা প্রায় দেড় মাস সময় কাটিয়েছিলাম এবং বেশ আরাম-আয়েশেই ছিলাম। তারপরও বাবা এবং মার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেতে দেখতাম। কারণ আমরা কোনোভাবেই খবর পাচ্ছিলাম না আমাদের ফেলে আসা বাড়ির কী অবস্থা। সেটা কি এখনো টিকে আছে নাকি বানের জলে ধসে পড়েছে? অবশেষে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর প্রায় দেড় মাস পর আমরা বাড়িতে ফিরে এলাম।
কিন্তু একি! চারিদিকে যেন ধ্বংসস্তূপের ছড়াছড়ি! যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো এলাকা। দীর্ঘদিন বন্যার পানি আটকে থাকায় বেশিরভাগ মাটির ঘরগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এক একটি বাড়ি যেন এক একটি মাটির ঢিবিতে পরিণত হয়েছিল এমনই একটি মাটির ঢিবির উপরে মাথায় হাত দিয়ে দাদুকে বসে থাকতে দেখলাম। তিনি আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন সাবধানে চলাফেরা করিস হে দাদুভাই! আনাচে-কানাচে সাপ খোপ লুকিয়ে থাকতে পারে।বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে দেখলাম, আমাদের ঘরটি অক্ষতই রয়েছে। তবে অনেকেই পরামর্শ দিলো এই ঘরে বসবাস না করতে, যদিও এটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে আমরা সেই ঘরে উঠলাম। সবচেয়ে বেশি খুশি হলাম আমি। যেন পুরোনো রাজত্বে ফিরে এলাম।
এই ঘটনার পরে আরও কয়েকবার আমরা বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো এত দীর্ঘস্থায়ী ছিল না এবং এগুলোর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও এমন ছিল না। আমার মনে আছে, এরকম কোনো এক ছোট বন্যার সময় বাবা হাট থেকে একটি কোষা নৌকা কিনে এনেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, নিজেরা বন্যার সময় এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো এবং মানুষকে পারাপার করে যদি কিছু আয়ের ব্যবস্থা করা যায়।
আমার মনে আছে, পুরো পরিবারের সবাইকে নিয়ে আব্বা এবং চাচা মিলে এই নৌকা চালিয়ে আমরা বিলের অথৈ জলের ওপর দিয়ে ভেসে শহরের অদূরে শালুকা গ্রামে আব্বার ফুফুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। যাওয়া এবং আসার পথে টানটান উত্তেজনায় ভরপুর সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। নদীর বুকে ভেসে চলা, চারপাশের ডুবন্ত গ্রামগুলো দেখা—সবকিছুই যেন এক স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। মাঝেমধ্যে নৌকাটি একটু বেশি নড়াচড়া করলে মায়ের মুখে ভয়ের রেখা ফুটে উঠতো, আর আমরা শিশুরা তাতে আরও বেশি মজা পেতাম। আব্বা আর চাচা গল্প করতে করতে নৌকা চালাতেন, আর আমরা জলের ছোঁয়া নিয়ে খেলায় মেতে উঠতাম। সূর্যাস্তের আলো যখন বিলের জলে প্রতিফলিত হতো, তখন সেই দৃশ্য ছিল এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। যেন প্রকৃতি তার সমস্ত রঙ নিয়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছে এক জীবনের গল্প।
আনন্দ ভ্রমণ ঠিকই হয়েছিল, কিন্তু ওই নৌকা থেকে কোনো আয় করা সম্ভব হয়নি, কারণ সেবারের বন্যা মাত্র দশ দিন স্থায়ী হয়েছিল। বন্যা শেষ হয়ে গেলে, ডাঁড়ার বাঁক নেওয়ার কারণে যেখানে গভীরতা একটু বেশি, সেখানে নৌকাটি ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, এতে নৌকা ভালো থাকবে এবং মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করার মাধ্যমে খালের মাছ ধরা সম্ভব হবে। আর পরের বছরের বন্যার সময় যদি ততদিনে নৌকা ভালো থাকে, তাহলে আবারও ব্যবহার করা হবে।
আমার মনে আছে, এর মাস চারেক পর যখন শুষ্ক মৌসুমে খালটি প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো, তখন আমি, বাবা এবং চাচারা মিলে এই নৌকাটি জাল দিয়ে ঘিরে পানির উপরে টেনে তুললাম। অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম নৌকার গহ্বরে এবং চাটার নিচে ছোট-বড় অসংখ্য শোল মাগুর পুটি তেলাপিয়া মাছ ছোটাছুটি করছে। আমার যে কী আনন্দ হয়েছিল! যেন এক গুপ্তধন পেয়েছি। এই মাছগুলো আমরা সবাই মিলে ধরেছিলাম। সেই দিনটির কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। বাবা আর চাচা মিলে মাছগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন আর আমরা ছোটরা আনন্দে চিৎকার করতে করতে তাদের অনুসরণ করছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মাছ তো ঠিকই পেয়েছিলাম, কিন্তু নৌকাটি আর ব্যবহার করার মতো অবস্থায় ছিল না। কাঠগুলি পাকা না হওয়ায় পচন ধরেছিল, আর সেটি এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে আর জলে ভাসানোর সাহস হয়নি। ফলে সেটির গন্তব্য হয়েছিল মা’র চুলা!
এরপর দিন অনেক অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার শৈশবের স্মৃতিময় “ডাঁড়া” নামে পরিচিত শুঁয়োরমারী খালটি আজও রয়েছে, তবে তা ইট-কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া এবং উপরে স্ল্যাব বসানো তিন হাত চওড়া ড্রেন হিসাবে। যে ড্রেনের উপরে বসানো স্ল্যাবের রাস্তা ধরে মানুষ এখন চলাফেরা করে। দূর থেকে দেখলে কিংবা এ যুগের ছেলেমেয়েরা কল্পনাও করতে পারবে না, এককালে এখানে একটি খরস্রোতা খাল ছিল। যে খালের পানিতে আমরা নৌকা, কলা গাছের ভেলা চালিয়ে সাঁতার কেটে বড় হয়েছি। মাছ ধরেছি বরশি আর জাল দিয়ে। এককালে যে খালের এই পাশ থেকে ওই পাশে যাওয়ার জন্য মানুষ বাঁশের আঁড়/সাঁকো ব্যবহার করত। যা এখন শুধুই হারানো স্মৃতি।
এখন যখন আমি সেই ড্রেনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাই, তখন আমার মনের কোণে ভেসে ওঠে অতীতের ছবি। শুনতে পাই ছোটবেলার বন্ধুদের কোলাহল, জলের কলকল শব্দ, আর বাবার কেনা কোষা নৌকার তলায় লাগা জলের মৃদু আওয়াজ। হয়তো এই নতুন প্রজন্মের কাছে এটি কেবলই একটি ড্রেন, কিন্তু আমার কাছে এটি আমার শৈশবের জীবন্ত স্মৃতি, যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। সেই ডাঁড়া এখন কেবলই একটি স্মৃতি, কিন্তু তার প্রভাব আমার জীবনে আজও অমলিন।
~@বিপুল…..