ছোট গল্প:আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা
✍️ রচনাঃ মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌺
চাঁদপুর জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত এক শান্ত, সবুজে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম নূরনগর। নামের মতোই এই গ্রামটি যেন এক নূরের ছায়া—চারদিকে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, ঝাকড়া নারকেল গাছ, বয়ে চলা ছোট নদী, আর মাঝে মাঝে পাখির কলতান। এই গ্রামেই বাস করতেন এক তরুণ, যার নাম ইকবাল শেখ।
ইকবাল ছিলেন মজবুত আকীদার একজন দ্বীনদার যুবক। যদিও কোনো আলেম ছিলেন না, তবুও দীনের ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিল প্রখর। সে নিয়মিত কুরআন পড়ত, নামাজ আদায় করত, ও তার জীবনকে সুন্নতের আলোয় সাজানোর চেষ্টা করত। কিন্তু তার বড় গুণ ছিল—সে মানুষকে ভালোবাসত কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যেই, আর ঘৃণা করত আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের শত্রুদের।
একজন দীনের সাথী
গ্রামের পাশের মসজিদের ইমাম ও হাফেজ সাহেব ছিলেন একজন পরহেজগার মানুষ, নাম হাফেজ সিরাজুল হক। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, অসুস্থতাও তাকে ঘিরে রেখেছে। একদিন ভোরে, ফজরের পর, ইকবাল শেখ কাঁধে এক ব্যাগ ওষুধ নিয়ে হাজির হলো হাফেজ সাহেবের দরজায়।
– “হুজুর, আজকে দোকান খোলার আগেই ভাবলাম আপনার খোঁজ নিয়ে যাই। আপনার জন্য কিছু ওষুধ এনেছি। কুরআনের কিছু আয়াতও শুনিয়ে যাই, শুনলে আপনার মন হালকা হবে ইনশাআল্লাহ।”
হাফেজ সাহেব কান্না চেপে রেখে বললেন,
– “ইকবাল, তুই আমার আপনজনের চেয়েও আপন। এমন ভালোবাসা তো আজকাল কেউ দেয় না।”
ইকবাল মাথা নিচু করে বিনয়ের সাথে বলল,
– “হুজুর, আমি আপনাকে এই দুনিয়ার কোনো স্বার্থে ভালোবাসি না। আপনি আল্লাহর রাহে মানুষকে কুরআন শিখান, তাই আপনাকে আমি কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসি।”
অন্যদিকে অন্য বাস্তবতা
এই একই গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল হাকিম মিয়া—গ্রামের মেম্বার। বাহ্যত সালাম-দোয়ায় ভরা, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে ছিল একজন দুর্নীতিবাজ, সুদখোর, ঘুষখোর, ও গরীবদের ওপর অত্যাচারকারী। আল্লাহর বিধানকে তুচ্ছ করে সে তার সম্পদ বাড়াতেই ব্যস্ত ছিল।
একদিন ইকবালের দোকানে এসে বলল,
– “ইকবাল, আমাকে এক মাসের জন্য খাতা খুলে কিছু মাল দিয়ে দে। টাকা পরে দিব।”
ইকবাল শান্তভাবে তাকিয়ে বলল,
– “মাফ করবেন মেম্বার সাহেব। আপনি যেভাবে হারাম পথে সম্পদ অর্জন করেন, মানুষ ঠকান, সুদ খান—আমি আল্লাহর জন্য আপনাকে পছন্দ করি না। আর আল্লাহর জন্যই আপনাকে এই লেনদেন দিচ্ছি না।”
হাকিম মিয়া রাগে মুখ লাল করে ফেলল, কিন্তু আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন অবাক হয়ে ইকবালের সাহস আর ঈমানী দৃঢ়তা দেখে হতবাক হয়ে গেল।
ভালোবাসার নিঃস্বার্থতা
ইকবাল শেখ নিয়মিত শিশুদেরকে কুরআন শেখায়, বৃদ্ধদেরকে বাজার করে দেয়, অসুস্থদের সেবা করে। বিশেষ করে আলেম, হাফেজ, মাদরাসার ছাত্রদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অগাধ।
প্রতি শুক্রবার জুমার পর বাড়িতে দাওয়াত দিত সে। নিজ হাতে রান্না করে, একেকজন আলেম ও তালিবে ইলমকে নিয়ে এসে খাওয়াত।
লোকেরা জিজ্ঞেস করত,
– “ইকবাল ভাই, আপনি তো কোনো বড়লোক নন, তবুও এত খরচ করেন কেন?”
সে হেসে বলত,
– “এরা আল্লাহর রাস্তার মানুষ। আমি তাদের ভালোবাসি শুধু আল্লাহর জন্য। কিয়ামতের দিন আল্লাহ যাদেরকে আরশের ছায়া দেবেন, আমি তাদের একজন হতে চাই।”
শেষ বিদায়
বছরখানেক পর এক শীতের সকালে ইকবাল শেখের হঠাৎ মৃত্যু হয়। হার্ট অ্যাটাকে তাঁর তরতাজা জীবন থেমে যায়। গ্রামে যেন শোকের ছায়া নেমে আসে। জানাজায় মানুষ উপচে পড়ে। আলেম, গরীব, বৃদ্ধ, শিশু—সবাই উপস্থিত।
হাফেজ সিরাজুল হক জানাজার পর বললেন,
– “এই ছেলেটি এমন একজন ছিল, যে কাউকে ভালোবাসত কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আমি গর্ব করে বলছি, ইকবাল শেখ কিয়ামতের দিন সেই মানুষদের একজন হবে যাদের আল্লাহ নিজ ছায়ায় স্থান দেবেন। ইনশাআল্লাহ।”
হাদীসের আলোকে
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
> عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: إِنَّ اللهَ يَقُوْلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَيْنَ الْمُتَحَابُّوْنَ بِجَلاَلِى الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِىْ ظِلِّىْ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلِّىْ
(মুসলিম, মিশকাত হা/৫০০৬)
অনুবাদ:
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন,
“ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘যারা আমার মর্যাদার খাতিরে পরস্পর ভালোবাসত, তারা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় স্থান দেব। আজ এমন দিন, আমার ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া নেই।’”
শিক্ষা ও বার্তা:
আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা—এটা ইমানের সর্বোচ্চ স্তর।
ইকবাল শেখ আমাদের শিক্ষা দেয়, এই দুনিয়ার মোহ, মানুষ আনন্দ বা লাভ-ক্ষতির চিন্তা নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালোবাসা ও সম্পর্ক গড়ে তুলাই মুমিনের পরিচয়।
সমাপ্ত
✍️ রচয়িতা: মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌺
আরবি প্রভাষক বলদীআটা ফাজিল স্নাতক মাদ্রাসা ধনবাড়ী টাঙ্গাইল জেলা।