জীবনের আশি বসন্ত পেরিয়ে আসা জীর্ণ দেয়ালের মতো বৃদ্ধ দেবেন্দ্রনাথ, বাঁশের মাচার উপর বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন পথের দিকে। সে পথ, যা গত পাঁচ বছর ধরে তার একমাত্র নাতি রণজিৎকে বয়ে আনেনি। ভোরের মিষ্টি রোদ তার কাঁপা হাতের চামড়ায় মেখে গেছে, কিন্তু উষ্ণতা তার ভেতরে পৌঁছায় না। বুকের গভীরে জমে থাকা হিমশীতল শূন্যতা, সে যে এক মহীরুহের ভাঙন! প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা, যখন এই গ্রাম বাংলাতে মোবাইল ফোনের নামও কেউ শোনেনি, চিঠিই ছিল একমাত্র ভরসা। আজ চিঠিও আসে না, শুধু রাতের নিস্তব্ধতা আর আঁধার ঘনিয়ে আসে তার সঙ্গী হয়ে।
দেবেন্দ্রনাথের দিনগুলো যেন একেকটি দীর্ঘশ্বাসের মালা। সূর্য উঠলে তার উঠোনে জমে থাকা নিস্তব্ধতা আরও প্রকট হয়। একমাত্র নাতি রণজিৎ, তার বুকের পাঁজরের শেষ টুকরো, সে এখন আফ্রিকার কোনো এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে। “আসছি, দাদু,” শেষবার সে বলেছিল পাঁচ বছর আগে, তার রুগ্ন মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে। তারপর থেকে কেবল অপেক্ষার প্রহর গোনা। চিঠি অবশ্য আসতো দু’একখানা, তাতে থাকতো জটিলতার ফিরিস্তি—আসা হচ্ছে না, আরও কিছুদিন থাকতে হবে। রণজিতের হয়তো ফেরার তাগিদও তেমন নেই, অথবা জীবনের কঠিন পথ তাকে অন্য কোনো মোহে বেঁধেছে। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের জীবনে তো আর কোনো মোহ নেই, আছে কেবল স্মৃতি আর প্রতীক্ষা।
বার্ধক্য তাকে গ্রাস করেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়েছে, কানে আর আগের মতো শোনেন না। দিনের বেলায় দাওয়ায় বসে তিনি গুনগুন করে গান করেন, যে গানের সুর বহু বছর আগে তার স্ত্রী সরস্বতীর কণ্ঠ থেকে উঠে আসত। সরস্বতী, আহা সরস্বতী! তার স্মৃতির ভাঁড়ারে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। কত যে বসন্ত পেরিয়েছে এক ছাদের নিচে। দেবেন্দ্রনাথের চোখে ভাসে সরস্বতীর মুখ। শান্ত, স্নিগ্ধ মুখখানি, যেন শরৎকালের মেঘমুক্ত আকাশ। তাদের প্রথম সন্তান, লক্ষ্মী যখন পৃথিবীর আলো দেখেছিল, সরস্বতী সেদিন যেন শতগুণে রূপবতী হয়ে উঠেছিল। সেই লক্ষ্মী, তাদের আদরের মেয়ে, মাত্র বাইশ বছর বয়সে এক কঠিন অসুখে ঢলে পড়ল। দেবেন্দ্রনাথের মনে পড়ে, কেমন করে তিল তিল করে সে শুকিয়ে গিয়েছিল, যেন বসন্তের ফুল শুকিয়ে যায়। সরস্বতী সেদিনও ভেঙে পড়েননি, শক্ত হাতে আগলে রেখেছিলেন সংসার। কিন্তু মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে তার হাসি যেন মিইয়ে গিয়েছিল, নিভে গিয়েছিল চোখের তারার জ্যোতি।
এরপর এসেছিল তাদের ছেলে, রণজিতের বাবা। সেও সংসারের হাল ধরেছিল, কিন্তু সময়ের নির্মম পরিহাস তাকেও কেড়ে নিয়েছিল। এক বর্ষার রাতে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সেও চলে গেল। সরস্বতী সেদিনও পাথর। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল নাকি পাথর হয়ে গিয়েছিল তার বুক, বোঝা যেত না। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, সরস্বতীর ভেতরের সবটুকু আলো নিভে গেছে। তিনি নিজেও তখন দিশেহারা। দু’জনের ভাঙা বুক নিয়েই তারা আঁকড়ে ধরেছিলেন রণজিৎকে। রণজিৎই ছিল তাদের সব। যখন রণজিৎ যুবক হলো, একদিন সরস্বতীও নীরবে বিদায় নিলেন। যেন সব দায়িত্ব শেষ, আর তার কোনো অভিযোগ নেই, কোনো প্রার্থনা নেই। দেবেন্দ্রনাথ সেদিন যেন একটি চলমান কবর হয়ে গিয়েছিলেন। যে মানুষগুলো তার জীবনের প্রতিটি কোষে মিশে ছিল, তারা একে একে বিলীন হয়ে গেল, শুধু স্মৃতি আর শূন্যতা রেখে।
দিনের শেষে যখন ক্লান্ত সূর্য দিগন্তে ডুবে যায়, দেবেন্দ্রনাথের একাকীত্ব আরও গভীর হয়। চারপাশের প্রকৃতি ঘুমিয়ে পড়ে, তার কানে শুধু নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ শোনা যায়, যেন এক প্রাচীন ঘড়ির টিক টিক। বিছানায় গা এলিয়ে দেন তিনি। দিনের বেলা যে নাতিকে দেখতে পান না, রাতের বেলা সে আসে কেবল স্বপ্নে।
স্বপ্ন, সে এক অন্য জগৎ। সেখানে কোনো দূরত্ব নেই, কোনো যুদ্ধ নেই, কোনো বিচ্ছেদ নেই। স্বপ্নে রণজিৎ আসে, সেই ছোটবেলার দুরন্ত ছেলেটি হয়ে। “দাদুভাই!” বলে সে জাপটে ধরে। দেবেন্দ্রনাথের চোখে জল আসে। স্বপ্নের রণজিতের চুলগুলো তিনি হাত বুলিয়ে দেন, তার কপালে চুমু খান। “কিরে, কবে ফিরবি দাদুভাই? তোর ঠাকুমা কত ডেকেছে তোকে!”
রণজিৎ হাসে, সেই নিষ্পাপ হাসি। “আমি তো এসেছি দাদু! আমি তো সবসময় তোমার পাশেই থাকি।”
কখনো কখনো স্বপ্নে আসে সরস্বতী। তার শাড়ির আঁচলের গন্ধ নাকে আসে। “কী গো, এখনো জেগে আছ?” সরস্বতী নরম গলায় জিজ্ঞাসা করে। দেবেন্দ্রনাথের বুকের ভেতরের সব হাহাকার যেন এক নিমেষে বের হয়ে আসে। “তুমি কেন চলে গেলে সরস্বতী? এই শূন্য ঘরে আমি কাকে নিয়ে বাঁচি? রণজিৎও যে নেই! আমার দিন কাটে না, রাত নামে না!” সরস্বতী কেবল মৃদু হাসে, যেন অদৃশ্য হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। “ধৈর্য ধরো গো। সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই আছে, তোমার পাশেই।”
আর কখনো আসে লক্ষ্মী, তাদের আদরের মেয়ে। তার সেই হাসিমাখা মুখ। “বাবা, কষ্ট পাচ্ছ?” লক্ষ্মীর কণ্ঠস্বর যেন ভোরের শিউলি ফুলের মতো কোমল। দেবেন্দ্রনাথের মনে হয়, তার জীবনের সব ভালোবাসা যেন এই কণ্ঠস্বরে ভরে আছে। “তোরা সব কোথায় চলে গেলি মা? আমি যে একা হয়ে গেলাম!” লক্ষ্মী তার হাত ধরে, “আমরা তো তোমার মনেই থাকি বাবা। তুমি চোখ বন্ধ করলেই আমাদের দেখতে পাবে।”
ভোর হয়। সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন দেবেন্দ্রনাথের চোখে পড়ে, স্বপ্ন ভেঙে যায়। বিছানা ভিজে থাকে চোখের জলে। বালিশের পাশে রাখা চশমাটা তিনি তুলে নেন, কাঁপাকাঁপা হাতে পরেন। ঘরের প্রতিটি কোণ যেন বিদ্রূপ করে হাসে তার একাকীত্ব দেখে। দাওয়ায় এসে বসেন তিনি। আবার সেই পথপানে চেয়ে থাকা। হয়তো আজ চিঠি আসবে, হয়তো আজ কেউ এসে বলবে, “দাদুভাই এসেছে!” কিন্তু দিন শেষে তিনি জানেন, “সে আসে কেবল স্বপ্নে”। এই যে বেঁচে থাকা, এ যেন কেবল স্বপ্নের অপেক্ষায়। তার জীবন এখন এক চলমান কাব্য, যেখানে শেষ স্তবকটি লেখা হয়নি এখনো, শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা।
~@বিপুল……