🌺 ইশকে ইলাহী: হৃদয়ের নিখাদ ভালোবাসা
🖊️ রচনায় :মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
✓ ২৫ জুলাই ২০২৫
ভূমিকা
প্রেম—মানব হৃদয়ের চিরন্তন অনুভূতি। কিন্তু এই প্রেম যখন সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদিত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে আত্মার মুক্তি, অন্তরের তৃপ্তি এবং চিরজীবনের সফলতা। কবিতায় “ইশকে ইলাহিতে জ্বলে হিয়া” শিরোনামে যে হৃদয়-দহন চিত্রিত হয়েছে, তা কেবল দুনিয়াবি প্রেমের নয়; বরং মহান আল্লাহর প্রতি এক নিবেদিত আত্মার উন্মোচন। এ কবিতা আত্মার মোহ, অন্তরের যাত্রা ও আল্লাহর প্রেমে ফানার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে অনন্যরূপে।
আত্মিক অন্বেষণ ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা
প্রবন্ধের শুরুতেই কবি বলেন:
> “ইশকে ইলাহিতে জ্বলে হিয়া, কূলকিনারা নাইরে দিয়া,
বাঁধিয়াছি আরশি নূরের ঝলমল সুতোরে।”
এখানে কবি বুঝিয়েছেন, আল্লাহর প্রতি যে ভালোবাসা, তা সীমাহীন, অতলান্ত। সেই ভালোবাসা মানুষকে এমন এক পর্দাহীন অবস্থায় নিয়ে যায় যেখানে ‘আমি’ বিলীন হয়ে যায় এবং ‘তুমি’ হয়ে ওঠে একমাত্র আরাধ্য। ইহলৌকিক প্রেমের মতো নয়, বরং ইলাহী প্রেম এক গভীর আত্মিক তাড়না, যেখানে আত্মা আরশের নূরে বাঁধা পড়ে।
পার্থিব মোহ থেকে আধ্যাত্মিক মোহে রূপান্তর
কবিতার পরবর্তী চরণগুলোতে দেখা যায়:
> “আজ মজেছে মোর প্রাণ ও জান,
সুবহে সাদিক জিকিরে, সেজদায় অনলে দিয়া।”
সেজদার আগুনে আত্মা পুড়ে পবিত্র হয়। এ যেন দুনিয়ার সমস্ত মোহ-মায়া পেছনে ফেলে এক ঈমানদীপ্ত আত্মা আল্লাহর দরবারে মগ্ন হয়ে পড়েছে। সুবহে সাদিকের সময় জিকিরে মগ্ন থাকা যেন এক গোপন আত্মিক নির্জনতা, যেখানে অন্তরের সত্যিকারের শান্তি নিহিত।
অন্তরের সাফর ও আত্মার যাত্রাপথ:
কবি বলেন
> “চলিয়া যাইতুম বাইতুল্লাহ, মরুতে হেরা গুহা,
গাও মেলিয়া ওজুর জলে, তাহার রহমত কলসে।”
এখানে বাইতুল্লাহ ও হেরা গুহা এক ঐশী আত্মার পবিত্র গন্তব্য। একজন মুমিনের হৃদয়ও এমন যাত্রায় ব্যস্ত থাকে—আল্লাহকে পাওয়ার। “ওজুর জলে রহমত কলস” প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আত্মিক পরিশুদ্ধির, যা আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যায়।
আত্মসমর্পণের দৃঢ়তা ও পরিণতি
আবার কবি বলেন:
“মশগুল থাকিয়া তাওহীদের প্রেমে, নয় দুনিয়ার মোহ।”
এই চরণে নিহিত আছে ইসলামী আকিদাহর মৌলিক ভিত্তি: তাওহীদ। যখন একজন মুমিন আল্লাহর ভালোবাসায় ডুবে যায়, তখন দুনিয়ার সব মোহ, ভয়, লোভ—সব কিছু হারিয়ে যায়। বাকি থাকে শুধু তাঁর ইশক, যার কাছে আত্মা বারবার ফিরে যেতে চায়।
দুনিয়ার সীমা পেরিয়ে আখিরাতমুখী অনুপ্রেরণায়:
প্রবচনের মতো বলা যায়:
> “চলিবো পেরিয়ে লা-মাকানের চেতনাপথে,
রইবোনা হাওয়ার খাঁচায়, নয় দুনিয়াবি শৃঙ্খলে।”
‘লা-মাকান’ হল সেই সীমাহীন জগতের নাম—যেখানে আল্লাহর অস্তিত্ব অদৃশ্য হলেও সবচেয়ে প্রকট। কবি এখানে বলছেন, আত্মা দুনিয়ার শৃঙ্খল ছিঁড়ে আল্লাহর পথে উড়তে চায়। এই ভাবনা কুরআনের ঐ আয়াতের প্রতিফলন, যেখানে আল্লাহ বলেন:
“وَإِلَىٰ رَبِّكَ ٱلْمُنتَهَىٰ” — “তোমার প্রভুর কাছেই সমস্ত কিছু শেষ হয়।” (সূরা নাজম, আয়াত ৪২)
সমাজ ও উম্মাহর মিলনবিন্দু
> “জোড়া বেঁধে সকল ওম্মাহ মিলিবে তাওহীদের ছায়ায়।”
এই চরণে আছে উম্মাহর ঐক্য ও ঈমানের মূল ভিত্তি। আল্লাহর ভালোবাসা মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে বদলায়, আর সমষ্টিগতভাবে গড়ে তোলে এক শান্তিপূর্ণ সমাজ। তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যই উম্মাহর পরিপূর্ণতা।
পরিণতি: দুনিয়া নয়, জান্নাতের লক্ষ্য
শেষ দিকে কবি বলেন:
> “ইমানে মাটি খাঁটি হবে, থাকবে না দুনিয়ার প্রলোভন।”
এই পঙ্ক্তিতে আভাস পাওয়া যায়, সত্যিকার ঈমান মানুষকে খাঁটি করে তোলে, মোহমুক্ত করে। কুরআন ও হাদীসে এমন বহুবার বলা হয়েছে যে, আল্লাহর ভালোবাসা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই একজন মুমিনের চূড়ান্ত সফলতা।
উপসংহার:
“ইশকে ইলাহিতে জ্বলে হিয়া”—এ প্রবন্ধটি কেবল একটি আবেগঘন কাব্য নয়, বরং একটি আত্মিক আহ্বান। যে আহ্বানে ডাকা হয় প্রভুর প্রতি ফিরে আসার, আত্মার বিশুদ্ধতার, দুনিয়ার মোহ ছেড়ে পরকালের সফলতা অর্জনের। এই কবিতার সারমর্ম হলো—আল্লাহর প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, আত্মসমর্পণ এবং আত্মার অনন্ত মুক্তি। এটি আমাদের শেখায়, দুনিয়াবি প্রেম ক্ষণস্থায়ী হলেও ইলাহী প্রেম অনন্ত, নিরবিচার এবং মুক্তিদানকারী।