লৌহিত্য
– মোঃ মাজহারুল ইসলাম
ব্রহ্মপুত্র! তুমি কতই না ভাগ্যমান! তুমি বয়ে চলেছো আবহমান জলধারায়। তোমার কোনো কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, নেই কোনো যন্ত্রণা। তোমাকে শুনতে হয়না মানুষের কর্কশ শব্দ, সহ্য করতে হয়না আপ্লূত আবেগ।
ময়মনসিংহের কাছারিঘাটের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ইব্রাহীম নামের একজন যুবক স্বল্পস্বরে আনমনে এসব কথা বলছিলো।
তার বয়স ২৮ এর কাছাকাছি। বেকার যুবক। নিজের বাবা মা মারা গিয়েছিল ছোটবেলায়। ফলে এতিম এই ছেলের দ্বায়িত্ব শেষে তার চাচার উপরেই বর্তায়। চাচার সংসারে আদর যত্নের অভাব না পেলেও, বাবা মায়ের স্নেহ ও মমতার বড্ড অভাব সে বোধ করতো। তাই, ছোটবেলা থেকেই সে সবার থেকে আলাদা একাকি থাকতো।
বর্তমানে পূর্বের সেই একাকিত্ব বোধ তাকে আবারও ছোবল দিচ্ছে বারবার। জীবনের অনেক উত্থান-পতন দেখেছে সে। এখন তার চাই একটা ভালো চাকরি। কিন্তু, বিধি বাম! কোথাও একটা ভালো চাকরি হচ্ছে না তার। মোটা অংকের ঘুষ বা তদবিরের অভাবে বারবার সে ব্যর্থ হচ্ছে।
ঐদিকে চাকরির অভাবে আয়েশার বাবার কাছে সে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে দাঁড়াতেও পাচ্ছে না। হয়তোবা সেইদিন বেশি দেরি নেই যেদিন তার কাছে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আয়েশার অশ্রুসিক্ত ভাষায় কল আসবে।
সে বলবে, “আমাকে ভুলে যাও ইব্রাহীম!”
এ এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা! বেকারত্ব যেনো এ জগতের সবচেয়ে বড় বোঝার নাম। তাই, জীবন থেকে তার আর চাওয়ার কিছু নেই। সবকিছু এখন তার কাছে মরীচিকার মতো লাগে।
এসব ভাবতে ভাবতে সে ব্রহ্মপুত্র নদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ভাবে যদি আমি ব্রহ্মপুত্র হতাম তবে কতই না ভালো হতো। জীবন সংগ্রামের দুঃখ, কষ্ট, ঘৃনা, হতাশা, আবেগ, হারানোর ভয় ইত্যাদি তার সহ্য করতে হতো না। ব্রহ্মপুত্রের তীরে ইব্রাহিম তাই অনড়ভাবে দাড়িয়ে থাকে। সে আসলে জানে না তার ঠিক কি করা উচিত।
হঠাৎ একটা শীতল বাতাস ব্রহ্মপুত্রের তীরে বয়ে যায়। জয়নুল আবেদীন পার্কের প্রতিটি বৃক্ষের পাতা এ ধমকা বাতাসের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয় তাদের নাড়াচাড়ার মাধ্যমে।
তবে এ বাতাস অনড় ইব্রাহীমকে নাড়াতে পারলো না।
হঠাৎ, একটা শব্দে ইব্রাহীমের মতিভ্রম ভাঙ্গে।
“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কি সমাধান পাওয়া যাবে, মশাই।”
ইব্রাহীম আচমকা এই শব্দ শুনে এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকলো। সে কাউকে তার আশেপাশে না দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো। তাই, সে এ জায়গা প্রস্থান করবে এমন সময় আবার সেই অচেনা কণ্ঠস্বর বলে উঠলো,
“না… লাভ নেই মশাই। কি মনে করেছো, বারবার প্রস্থান করলেই কি সমাধান পাবে? এত সহজ!”
ইব্রাহীম কাঁপোকাপোঁ গলায় বললো, “কে আপনি! আর সামনে এসে কথা বলুন।”
“মশাই! তুমি ভারী মজার মানুষতো। জীবনের দুঃখ-কষ্ট যার সাথে শেয়ার করলে তাকেই চিনতে পারছো না।”
“বুঝলাম না।”
“আমার নাম ব্রহ্মপুত্র।”
“ব্রহ্মপুত্র!”
“আচ্ছা… শুনো তাহলে-
আমি ব্রহ্মপুত্র। আমার উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের নিকট জিমা ইয়ংজং হিমবাহে, যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। জাঙপো নামে তিব্বতে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে আমি ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করি যখন আমার নাম হয়ে যায় শিয়াং। তারপর আসামের উপর দিয়ে দিয়াং নামে বয়ে যাবার সময় আমার সাথে দিবং এবং লোহিত নামে আরো দুটি বড় নদী যোগ দেয় এবং তখন সমতলে এসে চওড়া হয়ে আমার নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। আমি হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কাছে এসে আমি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে জামালপুর ও ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পড়েছি। তা মশাই চিনতে পেরেছো আমি কে?”
“হুম। তবে…”
“তবে আর কি! আমার থেকে তুমি কি বেশি চড়াই উৎরাই দেখেছো? আমি চীন, ভারত ও বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। আমি এমন সময়ে ছিলাম, যখন বাংলাদেশের অস্তিত্বই ছিলো না। কোটি কোটি পলির আবেগ দিয়ে গড়া এই তোমার বাংলাদেশ। শতকোটি মানুষের উৎপত্তি-বিনাশ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সাক্ষী আমি নিজে।”
“আমার কি করা উচিত, বলুন? সবদিকে তো চেষ্টা করে দেখলাম, কোনো কিছুই তো আমার দ্বারা হচ্ছে না। আমি স্রেফ একটা লুজার।”
“ইব্রাহীম! তুমি জলধারার মত বয়ে যাও, থেমে যেওনা। থামলেই তুমি পিছিয়ে পড়বে। জানোইতো, সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। চেষ্টা করতে থাকো। ইনশাআল্লাহ রাস্তা তুমি পাবেই।”
“সত্যি বলতে আমার সামনে অন্ধকার দেখছি। কিঞ্চিৎ আলোর সন্ধান পেলেও আমি ঐদিকে ঝাপিয়ে পড়তাম। কোনো দিক খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”
“মশাই…. যখন দিকের কথাই বললে তখন বলি শুনো। আমার জীবনেও এমন একটা সময় এসেছিলো।
১৭৮৭ সালের আগে আমি ময়মনসিংহের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে বয়ে যেতাম। তবে ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে আমি ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই। আমার তলদেশ উত্থিত হওয়ার কারণে আমার দিক পরিবর্তিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমার নতুন শাখা নদীর সৃষ্টি হয়, যার নাম হয় যমুনা।
আমি কি ভূমিকম্পের ভয়ে আমার গতি থামিয়ে দিয়েছিলাম বলো? যদি থামিয়ে দিতাম তবে আমার আজ অস্তিত্ব থাকতো না।”
“আপনার তো গতি আছে ক্ষিপ্রতা আছে। আমার তো তা নেই।”
“কে বলেছে তোমার গতি ক্ষিপ্রতা নেই। যদি তোমার তা না থাকতো তবে তুমি ২৮ বছর পর্যন্ত আসতে পারতে না। তোমার ছোটবেলাতেই তোমার জীবনের ইতি ঘটে যেতো। অসহায়ত্ব ও একাকিত্বকে জয় করে আজ তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো সেই সুপ্ত ক্ষিপ্রতা নিয়েই। তোমার এখন শুধু চাই গতি। ভ্রম থেকে ওঠ যুবক! চেষ্টা করো আবার। আমি বলছি তুমি জয়ী হবেই।”
হঠাৎ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়। ব্রহ্মপুত্রের তীরসহ জয়নুল আবেদীন পার্ক ভিজে যায় বর্ষার জলধারায়। চারিদিকে মেঘের গর্জন আর বিজলি চমকাতে থাকে।
ইবরাহীম দ্রুত দৌড়ে কাছারিঘাটের ঘাটের কোনো এক চায়ের দোকানে এসে ভিড়ে বৃষ্টির কারনে। দুধের চায়ে-তে চুমুক দিতে দিতে সে ব্রহ্মপুত্রের সেই কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকে।
বছর খানেক পর আবার ইবরাহীম হাজির সেই কাছারিঘাটের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। না, এবার আর সে একা নয়। আয়েশা আর তার ছোট মেয়ে যমুনাকে কোলে নিয়ে সে তার পূর্বের জায়গাতেই আবারও এসে দাঁড়ায়।
দক্ষিণা বাতাসে সে স্মৃতিচারণ করতে থাকে।
সে তার অদৃশ্য বন্ধুকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। ব্রহ্মপুত্রও প্রতিত্তোরে তার কলকল ধ্বনি বাতাসে ভাসিয়ে দেয়।
যদি সেইদিন সে তাকে উপদেশ না দিতো তবে আজ এই অবস্থায় সে আসতে পারতো না। আজ সে সফল। অনেক কষ্টের পর একটা ভালো চাকরি পেয়েছে সে। আয়েশাকে সে বিয়ে করে চাকরি পাবার মাসখানেক পরেই। আজ সে তার স্ত্রী ও ৩ মাস বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে খুব খুশি।
ভূমিকম্পের ফলে দিক পরিবর্তন করে হলেও লৌহিত্য যেমন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে,
ঠিক তেমনি ভাবে ইবরাহীমের পরবর্তী প্রজন্মের অস্তিত্বকে ধারন করে রাখবে তার এই ছোট মেয়ে যমুনা।