• শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:২৯ পূর্বাহ্ন

“তুমি থেকেও ছিলে না” ✍️ এন আই বিপুল 

মোঃ নজরুল ইসলাম বিপুল / ৫০ বার পড়া হয়েছে
আপডেট: মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

“তুমি থেকেও ছিলে না”

এন আই বিপুল

২০১৭ সাল। কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম ছায়ায় ঢাকা এক অখ্যাত রেল স্টেশন, আহসানগঞ্জ, বাংলাদেশ। প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন সিমেন্টের বেঞ্চের ওপর ধুলোর আস্তরণ, আর তার নিচে বসে আছে দুটো ভাঙা হৃদয়। মেঘলা দুপুর, বাতাসের সাথে মিশে আছে পুরনো স্মৃতির সোঁদা গন্ধ। অনিকের চোখ প্ল্যাটফর্মের ধুলোমাটি দেখছে, আর শ্রেয়ার দৃষ্টি কৃষ্ণচূড়ার ঝরা পাপড়িতে। দুজনেরই গন্তব্য ভিন্ন, অপেক্ষা ভিন্ন ট্রেনের জন্য। কিন্তু নিয়তির খেলা বড় অদ্ভুত, এক অচেনা স্টেশনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাদের ভাঙা জীবনের মুখোমুখি।

অনিক: (মৃদু কাশি দিয়ে) এখনো তুমি অমন চুপচাপই আছো? পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেল, একটা কথা বলার সাহসও পাওনি।

শ্রেয়া: (চোখ না তুলেই) কথা বলার মতো কি কিছু অবশিষ্ট ছিল নাকি? সব তো পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিলে, এক নিমেষে। ছাইয়ের স্তূপে আবার কিসের ভাষা?

অনিক: ছাই? বাহ! এতোটা পথ এসেও তুমি নিজেকে ভুক্তভোগী সাজাবে? আগুনের ফুলকিটা প্রথমে কে ছুঁড়েছিল, মনে আছে? কোন হাতে আমাদের স্বপ্নের ইমারতটা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিলে?

শ্রেয়া: (তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে) স্বপ্ন? সে তো মরিচিকা ছিল অনিক! যেদিকেই হাত বাড়িয়েছি, শূন্যতা ছাড়া আর কিছু পাইনি। তোমার ভালোবাসা ছিল এক মায়াবী কুয়াশা, যার আড়ালে আসল সত্যটা ঢাকা পড়েছিল।

অনিক: আর তোমার সত্য? সে তো ছিল মরুভূমির তৃষ্ণার্ত বালুর মতো। যত জলই ঢেলেছি, সব শুষে নিয়েছে, বিনিময়ে দিয়েছে শুধু রুক্ষতা। মনে আছে সেই রাতগুলো? জোছনার আলোয় যখন তুমি আমার হাত ধরে বলতে, ‘তুমিই আমার আসমান, তুমিই আমার জমিন’? সব মিথ্যে ছিল তাহলে?

শ্রেয়া: আসমান আর জমিনের মাঝেও তো অদৃশ্য একটা পর্দা থাকে, অনিক। যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, আর আসল রূপটা দেখায় না। তোমার ভালোবাসার সেই আসমান ছিল রঙীন কাঁচের মতো, যার ওপর আমার স্বপ্নগুলো প্রতিবিম্বিত হতো, কিন্তু ধরতে গেলেই তা ভেঙে যেত।

অনিক: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) ধরতে তুমি কখনো চাওনি, শ্রেয়া। ধরতে চেয়েছিলে শুধু নিজের আকাশটা। যেখানে আমার ছায়াটাও যেন না পড়ে। তোমার সেই অভিমান, সেই নীরবতা… যেন কাঁটার মতো বিঁধতো। আমি কি আর তোমার পাশে ছিলাম না? প্রতিটি পদক্ষেপে তোমার হাত ধরে রাখার চেষ্টা করিনি?

শ্রেয়া: ছিলে! (কর্কশ স্বরে) তুমি ছিলে ছায়ার মতো। যাকে আঁকড়ে ধরতে গেলেই সে মিলিয়ে যায়। আমার যখন সবচেয়ে বেশি তোমার হাতের উষ্ণতা দরকার ছিল, তুমি তখন শীতের রাতের কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেলে। আমার প্রতিটি কান্নার শব্দ যখন বাতাসে মিশে তোমার কানে পৌঁছানোর কথা, তখন তোমার কানে পৌঁছাতো সমাজের কড়াপাতের ধ্বনি! আসলে, তুমি থেকেও ছিলে না, অনিক।

অনিক: (চোখ তুলে তাকায়) ছিলে না? আমি ছিলাম না? যখন তোমার বাবা বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন, যখন তোমার মা আমাকে অপমান করলেন, তখন আমি দিনের পর দিন ওদের দরজায় মাথা কুটে মরছিলাম। আর তুমি? তুমি এক নিমিষে মুখ ফিরিয়ে নিলে। একটা বারের জন্যও জানতে চাইলে না, আমার ভেতরে তখন কি প্রলয় বইছে। তুমি কি তখন ছিলে? আমার ভাঙা হৃদয়ের পাশে ছিলে? নাকি এক নিমিষেই পর হয়ে গেলে? আমার প্রতিটি শ্বাস তখন তোমার নাম জপতো, আর তুমি ছিলে এক অচেনা দূরের নক্ষত্র। আসলে, তুমি থেকেও ছিলে না, শ্রেয়া।

দূরে কোথাও একটা ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। ওদের খেয়াল নেই। সংলাপের সুতোয় যেন বাঁধ পড়ে গেছে, আর সেই সুতো ধরে টেনে আনছে পুরনো দিনের সব জমে থাকা রাগ, অভিমান, আর ভালোবাসার টুকরো স্মৃতি।

শ্রেয়া: নক্ষত্র? (হেসে ওঠে) তুমিই তো আমার পথ থেকে আলো সরিয়ে নিয়েছিলে। আমার জীবনে যখন আঁধার নেমে এলো, তখন তুমি সেই আঁধারের সঙ্গী না হয়ে বরং উল্টো পথে হেঁটেছিলে। তোমার কাছে আমার মান-অভিমান ছিল শিশুর খেলনা, তুচ্ছ।

অনিক: আর তোমার কাছে আমার ভালোবাসা ছিল এক ব্যবহার্য বস্তু, যা প্রয়োজন ফুরোলেই ফেলে দেওয়া যায়। সেই যে রাত জেগে তোমার জন্য কবিতা লিখতাম, সেই যে তোমার হাসির জন্য সারাদিন পাগলের মতো ঘুরতাম… সব কি অর্থহীন ছিল? মনে আছে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা? সেদিন তুমি বলেছিলে, এই গাছটা যেন আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকে। আজ এই সেই গাছ, আর আমরা দুজনে দুটো অচেনা মানুষ!

শ্রেয়া: সাক্ষী! (কটাক্ষ করে) গাছের মতো স্থির আর নির্বাক ছিল তোমার ভালোবাসা। ঝড় এলে যেমন গাছ কেবল দাঁড়িয়েই থাকে, আর ডালপালা ভেঙে যায়, তেমনি আমার জীবনে ঝড় আসতেই তোমার ভালোবাসা কেবল দাঁড়িয়ে ছিল, হাত বাড়ায়নি। তুমি কেবল দেখতে, অনুভব করতে পারতে না।

অনিক: আর তুমি? তুমি ছিলে এক উন্মত্ত নদী, যা তার গতিপথ নিজেই পরিবর্তন করে। কখনো স্থির থাকতে জানো না। প্রতি মুহূর্তে তোমার চাওয়া বদলাতো। আমি কোনদিকে যাবো, কোন স্রোতে ভাসবো, তুমিই তো আমায় পথ দেখাতে না। মনে আছে, আমার চাকরির প্রথম বেতনটা দিয়ে তোমার জন্য একটা ছোট্ট আংটি কিনে এনেছিলাম? তুমি বলেছিলে, “এই আংটিটা আমার সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।” সেই কথাগুলো কি আজ বাতাসে মিলিয়ে গেছে?

শ্রেয়া: (আংটির দিকে একবার তাকিয়ে) সে তো এক ক্ষণিকের উচ্ছ্বাস ছিল অনিক। যেমন শিশিরকণা সূর্যের প্রথম আলোয় চিকচিক করে, কিন্তু তারপরই মিলিয়ে যায়। তোমার সেই ভালোবাসা ছিল সেই শিশিরের মতো, যা আলোর দেখা পেতেই মিলিয়ে যেত। আর আমার জীবনে যখন সত্যিকারের সূর্যগ্রহণ নামলো, তখন তুমি ছিলে দূর আকাশের মেঘ।

অনিক শ্রেয়ার দিকে তাকায়। ওর চোখে জল চিকচিক করছে, কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। স্টেশন ছাড়ার ঘোষণা শোনা যায় মাইকে, কিন্তু তারা যেন অন্য জগতে ভাসছে। তাদের ট্রেন আসার আর ছাড়ার খবরও কানে যায় না।

অনিক: মেঘ? আমি তো তখন ঝড়ো হাওয়ার মতো তোমাকে ছুঁয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমিই তো আমাকে দূরে ঠেলে দিলে। তোমার পরিবার, তোমার সমাজ… তাদের সব কথা আমার কানে বজ্রের মতো আঘাত করতো, আর তুমি নীরব ছিলে। একটা বারের জন্যও আমার পাশে এসে দাঁড়াওনি। সেই যে তুমি বলেছিলে, “আমরা একসাথে সব বাধা পেরিয়ে যাবো,” সে তো কেবল কথার কথা ছিল।

শ্রেয়া: বাধা? (কান্না ভেজা কণ্ঠে) তোমার সেই সাহস ছিল না, অনিক। তুমি ছিলে এক কাঁচের পুতুল, যা একটু ধাক্কা লাগলেই ভেঙে যায়। আমার চোখে তখন কত স্বপ্ন, কত সাহস… আমি সব ছেড়ে তোমার হাত ধরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমিই তো আমাকে আটকে দিলে, এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে। আসলে, তুমি থেকেও ছিলে না, অনিক।

অনিক: শৃঙ্খল? (চেঁচিয়ে ওঠে) আর তুমি ছিলে এক বুনো হরিণীর মতো, যাকে বাঁধতে গেলেই সে আরও দূরে পালায়। আমি তোমার জন্য আমার পরিবার, আমার পরিচিত পৃথিবী… সব হারাতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তুমিই তো আমার বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছিলে। যখন আমি সবচেয়ে বেশি একা ছিলাম, যখন আমার ভেতরের মানুষটা ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছিল, তখন তোমার হাতটা আমার হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। আসলে, তুমি থেকেও ছিলে না, শ্রেয়া।

এক ঝোড়ো বাতাস এসে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি উড়িয়ে নিয়ে যায়। একটা ট্রেন হুইসেল দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মে ঢোকে। ওদের গন্তব্যের ট্রেন, কিন্তু ওদের আর হুশ নেই। ওরা যেন সময়ের গহ্বরে ডুবে গেছে। একসময় ট্রেন চলে যায়, প্ল্যাটফর্ম আবার নীরব হয়ে আসে। শুধু ওদের সংলাপের রেশ থেকে যায় বাতাসে।

শ্রেয়া: (ধীরে ধীরে) আমাদের গল্পটা একটা অসমাপ্ত কবিতার মতো, অনিক। যার শেষটা আর লেখা হয়নি।

অনিক: অসমাপ্ত নয়, শ্রেয়া। এটা একটা ভাঙা আয়নার মতো। যেখানে হাজারো প্রতিবিম্ব ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব ভেঙে গেছে।

শ্রেয়া: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হয়তো তাই। হয়তো নিয়তির খেলায় আমরা কেবল পুতুল ছিলাম।

অনিক: পুতুল….? হয়তো…..! অনিকের বুক ভেঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে…..

তারা দুজনেই চুপ করে যায়। কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় যেন এক গভীর নীরবতা নেমে আসে। ওরা জানে না, তাদের আর কোন গন্তব্য আছে কিনা। শুধু জানে, জীবনের পথ চলতে চলতে ওরা হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের অস্তিত্ব। এই অখ্যাত স্টেশনের বেঞ্চে বসে, তারা কেবল একে অপরের শূন্যতাটুকু অনুভব করে। দূরে কোথাও আবার একটা ট্রেনের শব্দ শোনা যায়, কিন্তু তাদের জন্য সে ট্রেন আর আসে না। তাদের গন্তব্য আজ শুধুই এক দীর্ঘশ্বাস, এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি।

~@বিপুল…..


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এজাতীয় আরো লেখা

📲 Kaj Kori App – মোবাইল দিয়ে ইনকাম করুন!

অ্যাপে রয়েছে Rocket Game, Ludo, Spin & Earn, আর্টিকেল রিডিং, রেফার বোনাস — ১০০ পয়েন্ট = ১ টাকা

📥 Kaj Kori App ডাউনলোড করুন