• মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:০৭ পূর্বাহ্ন

ঝন্টু মিয়ার হজযাত্রা: একটি অনুশোচনার গল্প। রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌼 প্রভাষক আরবি বলদিআটা ফাজিল মাদ্রাসা ধনবাড়ী টাঙ্গাইল জেলা। তারিখ:৩০/০৭/২০২৫

Reporter Name / ১৪০ বার পড়া হয়েছে
আপডেট: বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫

ঝন্টু মিয়ার হজযাত্রা: একটি অনুশোচনার গল্প

প্রথম অধ্যায়: শৈশব ও স্বপ্ন
বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হয়েছিল এক দরিদ্র কৃষকের ঘরে। তার নাম ছিল ঝন্টু মিয়া। ছেলেটি ছিল মেধাবী ও জিজ্ঞাসু প্রকৃতির। গ্রামের স্কুলে পড়াকালীন সময়েই শিক্ষকরা বুঝতে পেরেছিলেন—ঝন্টুর মধ্যে আছে বিশেষ কিছু। সে পড়াশোনায় যেমন মনোযোগী ছিল, তেমনি ছিল তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি ও যুক্তিবোধ। তার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল—একদিন ঝন্টু সরকারি বড় কর্মকর্তা হবে, গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, মেধার পাশাপাশি ঝন্টুর একটা দুর্বলতা ছিল—সে ছিল লোভী। ছোটবেলায় কেউ যদি তাকে অতিরিক্ত চকলেট দিত, সে তা গোপনে লুকিয়ে রাখত, অন্যদের না দিয়ে নিজেই ভোগ করত। কেউ যদি ভুল করে এক টাকা বেশি দিয়ে দিত, সে আর ফেরত দিত না। পরিবার কিংবা সমাজ কেউ তখন বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এই ছোট ছোট লোভ পরবর্তীতে তার চরিত্রে গভীর ছাপ ফেলে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: উচ্চশিক্ষা ও বিসিএস

ঝন্টুর জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন সে জেলা শহরের একটি সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও কঠোর পরিশ্রমে সে ভালো ফল করতে থাকে। এরপর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। ওখানে গিয়ে সে দেখে এক ভিন্ন বাংলাদেশ—যেখানে মেধার পাশাপাশি ক্ষমতা, সুপারিশ, এবং অর্থ কেমন করে মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ঝন্টু বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়। সে কঠোর পরিশ্রম করে, তবে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে সংশয়ে ছিল। তার কিছু সহপাঠী তখন প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। একদিন ঝন্টুর সঙ্গে পরিচয় হয় ড্রাইভার কেরামত আলীর সঙ্গে, যে নিজেকে “বড় বড় অফিসারদের খাস লোক” হিসেবে পরিচয় দেয়।
কেরামত আলী তাকে বলে, “ঝন্টু ভাই, মেধা দিয়ে হয়তো কিছু করা যায়, কিন্তু সময়ে সময়ে শর্টকাট রাস্তা ধরতে হয়। আপনি শুধু আমার কথায় থাকেন, বাকিটা আমার।”
দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগলেও শেষ পর্যন্ত ঝন্টু লোভ সামলাতে পারেনি। প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে ফলাফল ম্যানিপুলেশন—সবকিছুতেই হাত মেলে দেয়। এবং অবশেষে, সে সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যায়।

তৃতীয় অধ্যায়: ঘোষ বাণিজ্যের মোহ:
ঝন্টুর চাকরিজীবন শুরু হয় এক জেলায় সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে। শুরুতে সে কিছুটা নীতিগত থাকার চেষ্টা করে। তবে চারপাশের অবস্থা দেখে তার মানসিকতা বদলাতে থাকে। তার সিনিয়ররা সরাসরি ঘুষ চায়, সিস্টেমটাই যেন দুর্নীতির ওপর দাঁড়িয়ে। একদিন অফিসের একজন হিসাবরক্ষক তাকে বলে, “স্যার, সরকারি চাকরি মানেই হচ্ছে সুযোগ। আপনি যদি না নেন, অন্য কেউ নিবে।”
ধীরে ধীরে ঝন্টু নিজের বিবেককে চুপ করিয়ে দেয়। শুরু হয় ঘুষ বাণিজ্য—সরকারি প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে টাকা কাটা, দরপত্রে কমিশন নেওয়া, চাকরির বদলায় টাকা আদায়। সে যেন এক নতুন জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। নিজের চারপাশে তৈরি করে এক প্রভাবশালী বলয়।
সে একদিকে যেমন টাকা রোজগার করছিল, অন্যদিকে গরিবদের মাঝে কিছু দান-খয়রাতও করত। সে ভাবত, “একটু দান করলেই সব পাপ মাফ হবে।” মসজিদ নির্মাণ, মাদ্রাসা স্থাপন, এতিমখানায় অনুদান—সবকিছু সে করছিল যেন নিজের অপরাধ ঢাকতে।
ঝন্টুর জীবনে তখন আর কোনো অভাব নেই। বিলাসবহুল বাড়ি, দামি গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ—সবই ছিল তার নাগালে। সমাজে সে একজন “সম্মানিত” ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। দাড়ি রাখা, ইসলামি পোশাক পরা, নামাজে উপস্থিত থাকা—সবই ছিল তার নিয়মিত অভ্যাস। কেউ ভাবতেও পারত না যে, এই মানুষটি কতটা ভেতর থেকে ভঙ্গুর ও বদমাশ চরিত্রের লোক।

চতুর্থ অধ্যায়: হজের প্রস্তুতি ও প্রতারণার মুখোশ
ঝন্টু একদিন সিদ্ধান্ত নেয়—এবার সে হজে যাবে। নিজের জীবনের সব ভুল গোনাহ মাফ করাবে আল্লাহর দরবারে গিয়ে। চারদিকে সে প্রচার করে, “এবার হজে যাচ্ছি, আপনারা দোয়া করবেন।” মানুষ ভাবল, তিনি খুবই ধার্মিক ব্যক্তি। কেউ জানত না, এই হজযাত্রার অর্থের উৎস ছিল অবৈধ ঘুষের টাকা।
তার নামে পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়: “জনসেবায় নিয়োজিত এক সৎ কর্মকর্তার হজযাত্রা”। অথচ বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, এমনকি তার নামে চালু একটি এতিমখানার নামেও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ জমা পড়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশনে।

পঞ্চম অধ্যায়: পতনের শুরু

এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঝন্টু দেখে তার বাড়িতে হানা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দল। সার্চ ওয়ারেন্ট হাতে তারা তার সমস্ত সম্পত্তি তল্লাশি শুরু করে। কম্পিউটার, মোবাইল, হিসাবপত্র—সব জব্দ করা হয়। গণমাধ্যমে প্রচার হয়, “উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ৩০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ জব্দ।”
গ্রেফতার করা হয় ঝন্টুকে। সংবাদমাধ্যমে তার মুখ ভেসে বেড়ায় ঘুষখোর অফিসার হিসেবে। পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আত্মীয়-স্বজন মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার হজে যাওয়া তো দূরের কথা—জামিন পেতেই লেগে যায় মাসের পর মাস।

ষষ্ঠ অধ্যায়: অনুতাপ ও পরিবর্তন

জেলখানার অন্ধকার কক্ষে বসে ঝন্টু প্রথমবারের মতো জীবনের অর্থ খুঁজতে শুরু করে। বেঁচে থাকার সব অহংকার, প্রতিপত্তি, অর্থ—সব যেন বালুর ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। একদিন জেলখানায় এক বৃদ্ধ আসামি তাকে বলে,
“তুমি বড় অফিসার ছিলে, তাও কাঁদছো। আমি গরিব ছিলাম, কিন্তু মাথা উঁচু করে চলেছি। পাপ থেকে ফিরে আসো ভাই, আল্লাহ ক্ষমাশীল।”
এই কথাগুলো যেন ঝন্টুর হৃদয়ে গিয়ে বাজে। সে প্রথমবার সত্যিকারের তাওবা করে। জামিনে মুক্ত হয়ে সে আর পুরোনো জীবনে ফেরে না। ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করে, মাফ চায় যাদের প্রতারিত করেছে তাদের কাছে। গ্রামে ফিরে সে নিজেকে তাবলিগ জামাতে যুক্ত করে।

সপ্তম অধ্যায়: নতুন ঝন্টু
ঝন্টুর এখন কোনও অর্থ নেই, চাকরি নেই, গাড়ি নেই, সম্মান নেই—কিন্তু তার আছে এক নির্মল হৃদয়। সে প্রতিদিন মসজিদে যায়, তরুণদের সঙ্গে বসে ধর্মীয় আলোচনা করে, গরিবদের সহায়তা করে নিজ হাতে। সে বলে,
“ভাইরা, আমি একদিন ভাবতাম হজ করলেই সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু হজে যাওয়ার আগে নিজের অন্তরকে শুদ্ধ করতে হয়। হালাল উপার্জন ছাড়া ইবাদতের কোনও মূল্য নেই।”
লোকজন প্রথমে তাকে অবজ্ঞা করত, কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারে তার পরিবর্তন সত্যিকারের। মসজিদের ইমাম একদিন বলেন, “যে মানুষ ভুল করে, সে অপরাধী; কিন্তু যে নিজের ভুল স্বীকার করে তা থেকে ফিরে আসে, সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা।”

সমাপ্তি: একটি শিক্ষা
ঝন্টু মিয়ার গল্প আমাদের শেখায়—ধর্মীয়তা মুখোশ নয়, অন্তরের ব্যাপার। অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ দিয়ে কখনো হজ হয় না, হয় না আত্মার মুক্তি। বাহ্যিক নেককার রূপে সমাজকে ধোঁকা দেওয়া যায়, কিন্তু আল্লাহর চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না।
তাঁর জীবন যেন এক আয়না—যেখানে আমরা নিজের মুখ দেখতে পারি।

মূল বার্তা:
> অন্তরের পবিত্রতা ছাড়া ধর্মীয়তা অর্থহীন। ঘুষ, সুদ ও প্রতারণার টাকায় হজ নয়, বরং সৎ পথে চলার মধ্যেই আছে প্রকৃত তাওফিক।

রচনায়:মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌺 প্রভাষক:আরবি বলদিআটা ফাজিল মাদ্রাসা ধনবাড়ী টাঙ্গাইল জেলা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এজাতীয় আরো লেখা

📲 Kaj Kori App – মোবাইল দিয়ে ইনকাম করুন!

অ্যাপে রয়েছে Rocket Game, Ludo, Spin & Earn, আর্টিকেল রিডিং, রেফার বোনাস — ১০০ পয়েন্ট = ১ টাকা

📥 Kaj Kori App ডাউনলোড করুন