সেদিন হঠাৎ আব্বা ফোনে ছোটবোন নিশিতার বিয়ের কথা উঠালেন।
আমিতো রিতিমত অবাক। সবে নবম শ্রেনীতে পড়া নিশিতাকে কেন এত শীঘ্রই বিয়ে দিতে হবে বুঝলাম না। আব্বার একটাই কথা (অন্যসব মেয়ের বেলায় যেমন বলতো আরকি) মেয়ে মানুষ এত পড়িয়ে কি হবে,শেষ পর্যন্ত ঐ সংসার আর বাচ্চা সামলানো ছাড়া আর করবেই বা কি? তাছাড়া এমন ভালো ছেলে সব সময় হাতের কাছে পাওয়া তো যায় না।
নানা আপত্তির পর এক পর্যায়ে আমি জানতে চাইলাম ছেলেটি কে?
আব্বা বললে ছেলেটিকে তুমি চেনো, আমাদের গ্রামেরই ছেলে বকুল।
ওহ আচ্ছা বকুল, ওকে তো আমি ভালোভাবেই চিনি। অনেক আগে একবার ঢাকায় ওকে এক কোম্পানিতে চাকুড়ীও পাইয়ে দিয়েছিলাম। যদিও বেশিদিন করেনি।
তা এখন কি করে জানতে চাইলাম।
দ্বিগুন উৎসাহে আব্বা জানালো বিকোম পাশ করে, বর্তমানে চাচার "কুড়া চালুনি" মিলে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে, পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে চাকুড়ীর চেষ্টা তদবির করে যাচ্ছে।
জানতে পারলাম নিশিতাও রাজি।
আর মা'র কথা কি বলবো, তার বিশ্বাস আল্লাহ তার মরে যাওয়া ছেলেকে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন।(এখানে উল্লেখ্য যে আমার এক ভাই ছিল, যে কিনা ছোটবেলাতেই মৃত্যু বরন করে। ওর নামও ছিল বকুল।)
কি আর করা অনিচ্ছা সত্তেও দিনক্ষন ঠিক করা ও যাবতিয় কাজের জন্য আমাকে বাড়ীতে যেতে হলো।
পরদিন সন্ধায় দুইপক্ষের মুরুব্বীদের বসবার কথা।
গতরাত্রে বাড়ীতে এসেছি, সন্ধায় যেহেতু সবায় বসবে। হাতে অনেক সময়।
ভাবলাম অনেকদিন পর এসেছি বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি।
গ্রামের মেঠো পথ। পায়ে হেটেই যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে পালোয়ান চাচার সাথে দেখা। চাচা শ্রমোজীবি মানুষ, মসজিদে আজান দেয়। আমাদের অনেক স্নেহ করতেন।
কাছে এসে সালাম দিতেই ওনি বললেন, কি সব শুনতেছি বিপুল, তোমরা নিশিতা কে নাকি বকুলের সাথে বিয়ে দিচ্ছো?
তা ভালো করে সব খবর টবর নিয়েছো তো?
বকুলদের সাথে পালোয়ান চাচার পরিবারের একটা দুরুত্ব আছে জানতাম। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কি জানতাম না।
ভাবলাম শত্রুতার জের ধরে কোন কু মতলব নিয়ে এসব বলছে কে জানে।
হাসিমাখা মুখে বললাম, বকুল গ্রামের ছেলে, কোন সমস্যা থাকলে জানা যেত নিশ্চয়।
তাছাড়া আপনারা সবায় আছেন কিছু জানলে বলতেন না কি?
এবার পালোয়ান চাচা বলতে শুরু করলেন শোন বাবা, তোমার সাথে এখানে দাঁড়িয়ে বেশি কথা বলতে পারবোনা।
কেউ দেখে গিয়ে আবার কাসেমের গুষ্ঠিরে বললে, আমার সমস্যা হবে।
বকুল ছেলে হিসাবে খারাপ কিছু এখনো চোখে পরেনি। কিন্তু ওর বাবা আকরাম, ওর চরিত্রগত সমস্যা আছে। তার চোখের নজর খারাপ। তুমি হয়তো মনে করতে পারো তোমার বোনের বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য এসব বলছি। না বাবা, আকরাম যে কতবড় খোবিশ তা আমার চেয়ে আর বেশি কে জানে?
আমার মেয়ে রোজিনার বিয়ে দিয়েছিলাম বকুলের চাচা খোকনের সাথে। আর বকুলের ফুফুকে ঘরে এনেছিলাম আমার বড় ছেলে আফাজের বউ করে।
আমার ছেলে ও মেয়ের সংসার ভেঙ্গে যায় শুধু মাত্র বকুলের বাবা আকরামের কুদৃষ্টির কারনে। বকুলের ঘরে তোমার বোন কখনোই নিরাপদ নয়।
তোমারা আমার চোখের সামনে বড় হয়েছো। ভদ্রছেলে বলে আলাদা স্নেহও করি।
তাই কথাগুলি বললাম। কি মনে করলে জানি না। আমার কথা ধরে বিয়ে ভাঙ্গতে বলছিনা। তুমি একটু খোজ নাও।
আমি চাইনা আমার ছেলে মেয়ের জীবনে যা ঘটেছে, নিশিতার কপালেও সেই একই দুর্গতি নেমে আসুক।
চাচা চলে গেলেন। ওনি যে কথাগুলি বলে গেলেন তার কিছুই আমি জানিনা। জানার কথাও না কারন, ঘটনাটি আমরা এই গ্রামে এসে বাড়ী করারও অনেক আগে ঘটেছে।
বাড়ীতে ফিরে আসলাম আকাশ পাতাল চিন্তা করলাম। বকুল থাকবে না বাসায়, এদিকে হিংস্র বাঘের সামনে হরিনী সম অসহায় বোন। শশুরের নামে অভিযোগ করেও কোন ফল পাবে না। কারন বাবার নামে খারাপ কথা, কোন ছেলেকি সহজে বিশ্বাস করে?
কাওকে কিছু বললাম না মনে মনে বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়ার সুযোগ খুজতে থাকলাম। ভাবলাম গ্রামের ছেলে হওয়ায় বকুলের এবাড়ীতে যাতয়াত ছিলো, ওর প্রতি নিশিতার মনে কোন দুর্বলতা তৈরি হয়েছে কিনা জানার দরকার। ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
নিশিতা, মনেকর সবকিছু ঠিকঠাক কিন্তু তবুও কোন কারনে এই বিয়েটা হলনা, তোর কোন কষ্ট আছে?
নিশিতা নির্দ্বিধায় বলে দিলো, না ভাইয়া। আপনারা যেখানে দিবেন সেখানেই আমি রাজি। তবে এখনই বিয়েটা দিয়েন না। আমি আব্বাকে বলতে পারছিনা।
সেদিন বিয়েটা আমিই হতে দেইনি। যৌতুক সংক্রান্ত কারন দেখিয়ে বৈঠক ভুন্ডুল করে দেই।
পরবর্তি তিন মাস পর্যন্ত ওরা আমার পিছনে ঘোরাঘুরি করে।
আমার মনেও কিন্তু অনুশুচনা কাজ করতো। ভাবতাম কাজটা কি আমি ঠিক করলাম? পিতার দোষে পুত্রকে সাজা দিলাম কি না? মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেত।
সেই ঘটনার প্রায় চারমাস পর একদিন মা ফোন করে জানালো, যে আজকে গ্রামে একটা বিড়াট গ্রাম্যসালিশ বসেছিল। সেখানে পাশের গ্রামের এক যুবতি মেয়ের গায়ে অশালিন ভাবে হাত দেওয়া ও যৌন নির্যাতনেরর চেষ্টা করায় আকরাম চাচা কে ৭০ ঘা ও সবকিছু সত্য জেনেও বাবার পক্ষাবলম্বন করায় বকুলকে ৩০ ঘা পাদুকাঘাত দেওয়া হয়।
মার কাছ থেকে গল্পটা শুনার পর মনে মনে ভাবলাম, "বানর বুড়ো হয়ে গেলেও গাছে ওঠা ভোলে না"। সেদিনের ঐ বিয়ে ভাঙ্গার ঘটনায় বকুলের জন্য, মনের কোনে সামান্য ক্লেদ থাকলেও এখন আর নাই। কুকুরকে যতই সাবান দিয়ে গোছল করিয়ে ভালো পরিবেশে আনা হউক, ছাইয়ের গাদা পেলে সে একটা গরান দেবেই।
পরবর্তিতে নিসিতার বিয়ে সংক্রান্তা ঘটনা অপ্রাসংগিক তাই রচনা দির্ঘ্য করলাম না। তবে এই বিয়েকে কেন্দ্র করে বকুলদের পরিবারের এমন কিছু রুপ ফুটে উঠেছিলো যে সেগুলি বিয়ের পর প্রকাশ পেলে ঠোট কামরিয়ে কষ্ট সহ্য করা ছাড়া হয়ত আর কিছুই করার থাকতো না।
প্রকাশকঃ সবুজ হুসাইন।
সম্পাদকঃ মোঃ ইমদাদুল হক নয়ন।