✍️শিরোনাম: মিথ্যার আগুন ও সত্যের আলো
(গ্রামীন জীবনের ভুল বোঝাবুঝি ও সহীহ হাদীসের শিক্ষাভিত্তিক গল্প)
বগুড়া জেলার এক আদমদীঘি উপজেলা একটি পাড়া। শান্তিপূর্ণ সেই গ্রামের মানুষগুলো একে অপরের সুখ-দুঃখে পাশে থাকে, একসাথে নামাজ পড়ে, মাঠে কাজ করে। কিন্তু মানুষের মন তো আর সব সময় এক থাকে না। কখনও কখনও ঈর্ষা, হিংসা আর কু-গুজব এমনভাবে আগুন ছড়ায়, যেন সেই আগুনে পুড়ে যায় মানুষের মান-মর্যাদা ও শান্তি।
সেই গ্রামেই থাকত মজিদ আলী। পরহেজগার, নামাজি, শান্ত স্বভাবের এক কৃষক। তার স্ত্রী রোকসানা বেগম—শান্ত, পর্দানশীল, এবং গ্রামের অন্য মেয়েদের তুলনায় কিছুটা শিক্ষিত। তাদের সংসার ছিল সুখের, কিন্তু মানুষ সুখী হলে চারপাশে কিছু মুখ হিংসায় জ্বলে ওঠে—এই চিরন্তন সত্যটাই একদিন ভয়াবহ রূপ নেয়।
👉ভুল বোঝাবুঝির সূচনা
এক বিকেলে রোকসানা পাশের গ্রামের হালিমা খালার বাড়ি গিয়েছিল ওষুধ আনতে। পথে বৃষ্টি শুরু হয়। তখন হঠাৎ এক যুবক, স্থানীয় মাদরাসার ছাত্র সালেহ, তাকে ছাতা ধরে দেয়। সালেহ ছিল মজিদের ভাতিজা, খুব ভদ্র ছেলে। বৃষ্টিতে ভিজে তারা দু’জন একসাথে গ্রামে ফিরে আসে।
কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল আরেকজন—রহিম দর্জি। তার চোখে ছিল সন্দেহ আর মন ভরে ছিল হিংসায়। কারণ রোকসানাকে একসময় সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, যা প্রত্যাখ্যাত হয়। সেই থেকেই তার মনে ছিল প্রতিশোধের আগুন।
রহিম পরদিন হাটে গিয়ে কানাকানি শুরু করে দিল,
> “দেখছো, কাল রোকসানা কীভাবে সালেহর সঙ্গে বৃষ্টিতে ঘুরছিল? ব্যাপারটা ঠিক ভালো মনে হয় না!”
মানুষ তো কান দেয় গল্পে—কেউ যাচাই করে না, শুধু বাড়িয়ে বলে। দু’দিনের মধ্যে পুরো গ্রাম জানল, “রোকসানা ও সালেহ নাকি পরকীয়ায় জড়িত।”
মজিদ শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। সে স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারল না। গ্রামের মুরুব্বিরাও বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন শুরু করল।
🍌গ্রাম্য সালিশ
পরদিন জুমার নামাজের পর মসজিদের উঠানে সালিশ বসল। হুজুর, চেয়ারম্যান, মুরুব্বিরা সবাই উপস্থিত। রহিম বলল,
> “আমি নিজ চোখে দেখেছি! রোকসানা ও সালেহকে একত্রে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়।”
সবাই স্তব্ধ। রোকসানা কাঁদছে, সালেহ মাথা নিচু করে আছে। হুজুর শান্তভাবে বললেন,
> “দেখো, ইসলামে কারও উপর ব্যভিচারের (যেনা) অভিযোগ করা খুব বড় বিষয়। এটি প্রমাণ করতে চারজন বিশ্বস্ত সাক্ষীর প্রমাণ লাগে—যারা স্বচক্ষে দেখেছে এমন অবস্থায়, যেমন ‘সুরমা শলাকা সুরমাদানীতে ঢুকানো হয়’। শুধু দেখা বা ধারণা নয়।”
মজিদ অবাক হয়ে তাকাল হুজুরের দিকে। হুজুর তাফসির খুলে কুরআনের আয়াত পড়লেন—
> “আর যারা সতী নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে অথচ তাদের চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের আশি বেত্রাঘাত কর এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না।”
(সূরা আন-নূর: ৪)
আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসিকী এবং তাকে হত্যা করা কুফুরী।
শু’বাহ (রহঃ) সূত্রে গুনদারও এ রকম বর্ণনা করেছেন। (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫০৫)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬০৪৪
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
🍌হুজুর বললেন,
✓জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদল ইয়াহুদী তাদের মধ্যকার যেনার অপরাধী পুরুষ-নারীকে নিয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট হাযির হলো। তিনি বলেনঃ তোমাদের মধ্যকার সবচাইতে বিজ্ঞ দু’জন লোক নিয়ে এসো। অতএব তারা ‘সূরিয়ার’ দুই পুত্রকে তাঁর নিকট হাযির করলো। তিনি তাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে প্রশ্ন করেনঃ তোমরা এদের ব্যাপারে তাওরাতে কিরূপ বিধান দেখতে পাও? তারা বললো, আমরা তাওরাতে দেখতে পাই, চারজন সাক্ষী যদি সাক্ষ্য দেয় যে, তারা পুরুষটির গুপ্তাঙ্গ স্ত্রীলোকটির গুপ্তাঙ্গে এরুপভাবে ঢুকানো অবস্থায় দেখেছে, যেরূপ সুরমা শলাকা সুরমাদানীতে ঢুকানো হয়, তাহলে তাদের উভয়কে রজম করা হবে। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ তাহলে কোন জিনিসটা তোমাদেরকে তাদেরকে রজম করতে বাধা দিচ্ছে? তারা উভয়ে বললো, আমাদের শাসন ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। সুতরাং হত্যা করাকে আমরা অনুমোদন করি না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাক্ষীদের নিয়ে আসতে ডাকলেন। তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে এলো। তারা সাক্ষ্য দিলো যে, সুরমা শলাকা যেরূপে সুরমাদানীর ভেতরে ঢুকে যায়, ঠিক সেরূপেই তারা পুরুষটির গুপ্তাঙ্গ স্ত্রীলোকটির গুপ্তাঙ্গের মধ্যে ঢুকানো অবস্থায় দেখেছে। অতঃপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের রজম করার নির্দেশ দেন।
✓হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস (সুনানে আবু দাউদ -৪৪৫২)
“অর্থাৎ, ইসলাম কখনো সন্দেহ বা গুজবের উপর ভিত্তি করে শাস্তি দেয় না। বরং প্রমাণ ছাড়া কারও ইজ্জতের ওপর কথা বলা মারাত্মক গুনাহ।”
✍️ সত্যের পরীক্ষা
হুজুর রহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি বলছো তুমি দেখেছো? তাহলে আর তিনজন /৪ জন সাক্ষী কোথায়? যদি সাক্ষী না থাকে, তবে তুমি কাযফ (মিথ্যা অপবাদ) এর অপরাধে দোষী।”
রহিম ভড়কে গেল। সে বলল, “না হুজুর, আমি… আমি আসলে দূর থেকে দেখেছিলাম, ঘনিষ্ঠ মনে হচ্ছিল।”
💐হুজুর গম্ভীর গলায় বললেন,
“তুমি এখন বুঝে নাও, তুমি একজন পরহেজগার নারীর ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছো। এটি শুধু বড় পাপ নয়, বরং ইসলামে এর জন্য শাস্তি নির্ধারিত। তুমি ক্ষমা চাও এবং আল্লাহর কাছে তওবা করো।” এবং মিথ্যা অপবাদের শাস্তি ৮০ বেত্রাঘাত তোমাকে ভোগ করতে হবে।
রহিম কাঁদতে শুরু করল। সবার সামনে সে হাঁটু গেড়ে বসে রোকসানার কাছে ক্ষমা চাইল। বলল,
> “আমি ঈর্ষা থেকে বলেছিলাম। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন!”
মজিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
> “আমি আমার স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ পোষণ করে ভুল করেছি। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।”
রোকসানার চোখে অশ্রু, কিন্তু ঠোঁটে শান্তির হাসি ফুটল।
🍌 ইসলামী শিক্ষা ও বাস্তব শিক্ষা
সেদিনের সালিশের পর গ্রাম বটতলা পাড়ায় একটা পরিবর্তন আসে। হুজুর পরদিন জুমার খুতবায় বলেন,
> “যখন কেউ অন্যের ইজ্জতের ব্যাপারে কথা বলে, তখন মনে রাখবে—প্রমাণ ছাড়া কথা বললে সে নিজেই বড় অপরাধী হয়ে যায়। ইসলামে ব্যভিচারের প্রমাণ দিতে হবে চারজন সাক্ষীর দ্বারা, এবং তারা প্রত্যেকেই সেই ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করবে। অন্যথায়, অভিযোগকারীই গুনাহগার।”
তিনি আরো বলেন,
🍌আবূ যার (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ একজন অপর জনকে ফাসিক বলে যেন গালি না দেয় এবং একজন অন্যজনকে কাফির বলে অপবাদ না দেয়। কেননা, অপরজন যদি তা না হয়, তবে সে অপবাদ তার নিজের উপরই আপতিত হবে।[৩৫০৮; মুসলিম ১/২৭, হাঃ ৬১, আহমাদ ২১৫২১] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫০৬)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬০৪৫
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
💐 সত্যের আলো
রহিম তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে রোজা রাখল, নামাজে মন দিল, আর গ্রামের মানুষদের কাছে গিয়ে একে একে নিজের মিথ্যা কথা স্বীকার করল। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষদের মনেও পরিবর্তন এল—তারা আর কারও বিষয়ে গুজব ছড়াত না।
রোকসানা ও মজিদের সংসার আগের মতোই হাসিখুশি হয়ে উঠল। আর সালেহ তার শিক্ষায় মন দিয়ে একদিন স্থানীয় মসজিদের ইমাম হয়ে গেল।
বছরখানেক পর বটতলা পাড়ার মানুষ যখন এই ঘটনার কথা স্মরণ করত, তখন বলত—
> “মিথ্যার আগুনে পুরো গ্রাম পুড়ে যেতে পারত, যদি না সত্যের আলোয় হুজুর আমাদের চোখ খুলে দিতেন।”
💐নৈতিক শিক্ষা:
> 🔹 ইসলামে যেনার অভিযোগ প্রমাণ করতে চারজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীর দরকার।
🔹 প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করা মারাত্মক গুনাহ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
🔹 সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সমাজ গঠনই ইসলামের মূল শিক্ষা।
🔹 ঈর্ষা, হিংসা ও গুজব সমাজকে ধ্বংস করে, কিন্তু তওবা ও ক্ষমা সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনে।
🖋️–শেষ কলমে,
✍️মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🍌প্রভাষক হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা মান্দা, নওগাঁ।
✍️তারিখ:২৫/১০/২০২৫
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL ISLAM.