💐পূর্ব পাড়ার মানতুর ছাগল খামার: এক স্বপ্নের উত্থান।
✍️রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🌺তারিখ:২০/১০/২০২৫

পূর্ব পাড়ার সেই শান্ত গ্রাম, যেখানে সকালের বাতাস বয়ে আনত শিশিরভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আর আম-কাঁঠালের বাগানের মিষ্টি ঘ্রাণ। এই গ্রামেরই এক সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিল মানতু, সবুজ শেখের একমাত্র পুত্র। মানতু তখনো আজকের ‘বড় মাপের ছাগল পালনেওয়ালা’ হিসেবে পরিচিতি পায়নি। সে ছিল এক লড়াকু যুবক, যার চোখে ছিল স্বপ্ন, আর হাতে ছিল সংসারের হাল ধরার প্রচেষ্টা। পৈতৃক ভিটেতে সামান্য কিছু ছাগল ছিল বটে, তবে অভাবের তাড়নায় মানতুকে মাঝে মাঝে অটো চালাতে হতো। অটো চালকের সেই দিনগুলো ছিল কষ্টের, বিশেষ করে শীতকালে। ঠান্ডা শীতে তার কাশি আসতো ঘন ঘন। পকেটে সবসময় থাকত কাশির বড়ি – যেন ঠান্ডা আর কাশির বড়ি, এই দুটোই ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
কিন্তু মানতুর আসল মন পড়ে থাকত ছাগলগুলোর কাছে। সে দেখত ছাগলগুলো কী ভালোবেসে তিলের ভুসি খায়, আর সে তার সাধ্যমতো গমের ভুসিও জোগাড় করে দিত। ছাগলের প্রতি তার এই ভালোবাসা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির চেয়েও মূল্যবান।

মির্জাপুরের রাস্তা ও স্মৃতির সরণি

একদিন, মির্জাপুরের জনবহুল রাস্তায় অটো চালাতে চালাতে মানতুর ভীষণ কাশি উঠল। সে গাড়ি থামিয়ে কাশির বড়ি মুখে দিল। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে যখন সে দূরের মাঠের দিকে তাকাল, তখন তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল গ্রামের সেই দিনের ছবি, যখন তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।
তার মনে পড়ল, অটো চালানোর সময়ও তার মন জুড়ে থাকত ছাগলের রোগ-বালাইয়ের চিন্তা। বিশেষত ছাগলের ঠান্ডা কাশি মারাত্মক এক রোগ – অনেক সময় যা নিউমোনিয়াতে পরিণত হয়। এই জ্ঞান অর্জন ছিল তার  নেশা।

শাপলা আপার প্রশিক্ষণ: জ্ঞানের আলো

মানতুর মনে পড়ে গেল গ্রামের সেই আলোকিত দিনটির কথা। গ্রামের প্রাচীন স্কুল ভবনের একটি কোণে বসে শাপল আপা ছাগল পালনের উপর ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। শাপলা আপা, যার কন্ঠে ছিল সোহাগ মাখা স্নেহ আর চোখে ছিল গ্রামের প্রতি এক অদম্য ভালোবাসা। তিনি যেন গ্রামের মানুষদের ভাগ্য ফেরানোর ব্রত নিয়েছিলেন। মানতু মনোযোগ দিয়ে শুনত।
শাপলা আপা হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ছাগল পালনের আধুনিক পদ্ধতি। তিনি জোর দিয়েছিলেন ‘মাচা’ পদ্ধতির ওপর। “ছাগলকে প্রথমত মাচা করে রাখতে হয়,” শাপলা আপা বলতেন, “তাহলে ছাগলের চুনা (মলমূত্র) মাটিতে মিশে দুর্গন্ধ ছড়াতে পারে না। ছাগলের চুনায় অসংখ্য দুর্গন্ধ হয়, যা রোগ সৃষ্টির কারণ। সিঁড়ির মতো মাচার নিচ দিয়ে যাতে নাদা (মল) সহজে পরিষ্কার করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত পরিষ্কার না করলে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে মারাত্মক রোগ, এমনকি নিউমোনিয়াও সৃষ্টি হতে পারে।”

মানতু শিখেছিল, এই চুনা ও নাদা সঠিকভাবে পরিষ্কার করে জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করার কৌশলও। শাপলা আপা ছাগলের কাশি সহ নানা ধরনের রোগের কথা বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিলেন। তার ট্রেনিং-এর প্রতিটি কথা মানতুর মনের গভীরে গেঁথে গিয়েছিল। সেই ট্রেনিং-এর আলোকেই মানতু আজ সাহস করে বড় ধরনের ছাগলের খামার দিতে পেরেছে। শাপলা আপা তাকে শিখিয়েছিলেন কেবল ছাগল পালন নয়, বরং একটি লাভজনক খামার পরিচালনার বিজ্ঞান।

গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জীবনের ছন্দ

মানতুর গ্রামটি ছিল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আধার। গ্রামের চতুর্দিকে ছিল দিগন্তজোড়া শস্য ভরা মাঠ। একসময় এই মাঠে কেবল ধান চাষ হলেও, এখন খরায়না জমিতে গ্রামবাসীরা তিলের চাষ শুরু করেছে – যা মানতুর সফলতার অন্যতম ফসল। বসন্তে হলুদ সরষে ফুল আর হেমন্তে সোনালী ধানে মাঠ ভরে থাকত। দূর থেকে দেখলে মনে হতো যেন কেউ সোনার চাদর বিছিয়ে রেখেছে।
আম-কাঁঠালের বাগানগুলো ছিল গ্রামের আরেকটি ঐশ্বর্য। গ্রীষ্মের দুপুরে এই বাগানগুলো দিত শীতল ছায়া, আর শিশুরা সেখানে লুকোচুরি খেলত। মানতুর খামার এখন এই বাগানেরই এক অংশ।

গ্রামের মাঝখানে ছিল বিশাল ‘শাপলা-পুকুর’ (নামটি পরে গ্রামের লোকেরা শাপলা আপার সম্মানে দিয়েছিল)। পুকুরের জলে তেলাপিয়া মাছের আনাগোনা চলত। একসময় গ্রামের মানুষ কেবল বর্ষার জলে মাছ ধরত, কিন্তু এখন আধুনিক মৎস্য চাষের মাধ্যমে সারা বছরই তেলাপিয়া মাছের পর্যাপ্ত জোগান থাকে। গ্রামের মহিলারা পুকুর থেকে জল নিত, আর পুরুষেরা সেখানে জাল ফেলত। পুকুরের ধারে ছিল ঘন বটগাছ, যার নিচে বসে গ্রামের প্রবীণরা সকাল-সন্ধ্যা আলোচনা করতেন।

স্কুল ও মসজিদ: জ্ঞানের ও ঐক্যের কেন্দ্র

গ্রামের স্কুল ভবনটি ছিল জীর্ণ হলেও জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত। এখানেই শাপলা আপা মানতুকে ট্রেনিং দিয়েছিলেন। মানতু এখন প্রায়ই এই স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের ছাগল পালনের উপকারের কথা শোনায়। মসজিদটি ছিল গ্রামের প্রাচীনতম স্থাপত্য। আজান ধ্বনি যেন পুরো গ্রামকে এক সূত্রে বেঁধে রাখত। মসজিদটি কেবল উপাসনার স্থান নয়, বরং গ্রামের মানুষের মিলনক্ষেত্রও ছিল। মানতু এই মসজিদের সংস্কারেও বড় অঙ্কের অর্থ দান করেছে, কারণ তার মতে, গ্রামের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে ধরে রাখাও তার সাফল্যের অংশ।

খামারের উত্থান ও সাফল্যের জয়ধ্বনি

অটো চালানো ছেড়ে মানতু সম্পূর্ণভাবে ছাগল পালনে মন দিল। তার দিন শুরু হতো ভোর চারটায়, ছাগলের নাদা পরিষ্কার দিয়ে। শাপলা আপার ট্রেনিং মেনে সে ছাগলদের জন্য মাচা তৈরি করল। নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করত। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির ফলে অল্প দিনেই তার ছাগলের সংখ্যা বাড়ল। সে ‘ছাগল পালনে সেরা খেতাব’ অর্জন করল। মাঝে মাঝে সে কচু আবাদ করত এবং যে জমিতে সবসময় পানি থাকতো সেখানে পানিফলের চাষও করতো একসাথে কচু এবং পানিফল এর চাষ করেও সে কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছিল।
মানতু গ্রামে একটি সুপরিকল্পিত খামার তৈরি করল, যা এখন গ্রামের অন্যতম পরিচিতি। সে চতুর্দিকে মজবুত বেড়া দিয়ে ছাগলের থাকার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করল। সে জানত, ছাগলের দুধ, বিশেষ করে পাটি ছাগলের দুধ ছোট হলেও তার পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।
একসময় গ্রামে ছাগলের দুধের তেমন চল ছিল না। কিন্তু মানতুর খামারের গুণে আজ গ্রামের লোকেরা নিয়মিত ছাগলের দুধের পুষ্টিগুণাগুণ গ্রহণ করছে। মানতু ছাগলের দুধ বিক্রি করে শুধু অর্থ উপার্জন করছে না, সে যেন গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটাচ্ছে। বর্তমানে ব্লাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

চূড়ান্ত সফলতা ও গ্রামের উন্নয়ন

এই বছর মানতু ছাগলের ৫০টি বকরি বিক্রি করতে পেরেছে। এতে তার অনেক লাভ হয়েছে। সে আজ সফল খামারি। তার মনে পড়ে, এই সাফল্যের সিঁড়ি তৈরিতে সে কতটা কাশির বড়ি খেয়েছে আর কতটা পরিশ্রম করেছে।
মানতু শুধু নিজের সফলতা নিয়ে থাকেনি। সে গ্রামের অন্যান্য যুবকদেরও উৎসাহিত করেছে। তার দেখাদেখি গ্রামের লোকেরা তার খামারের বর্জ্য সার হিসেবে ব্যবহার করে খরায়না জমিতে তিলের চাষ শুরু করেছে। সেই তিলের তেল, যা এক নাম্বার তেল, তা ইফতারি তৈরিতে ব্যবহার করে তারা আজ বাজারে উচ্চমূল্য পাচ্ছে। পুকুরে তেলাপিয়া মাছের চাষও বেড়েছে। শুধুমাত্র তেলাপিয়া চাষ নয় সাথে পাঙ্গাসের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছিল তার খামারে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যখন গাভীর দুধু খায় তখন মানতো মাঝে মাঝে বলে আমার খামার থেকে পার্টি ছাগলের দুধ নিয়ে যেও অনেক গুনাগুন আছে। গ্রামের শিয়ালগুলো মাঝে মাঝে হুকা হুয়া ডেকে উঠে সন্ধ্যায়। মানতু এবার ছাগল পালন করে তার জা ঋন ছিল তা পরিশোধ করতে পেরেছে।

আজ, যখন গ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে, তখন তারা গর্বে মাথা উঁচু করে বলে:

পাটি”ছাগলের দুধের গুণে, তিলের চাষ করে, আর পুকুরে তেলাপিয়া মাছ সহ নানান চাষে আমরা আজ সফল হতে পেরেছি। মানতুই আমাদের এই সাফল্যের সিঁড়ি দেখিয়েছে!”যে ছাগলের চুনা দেখে মানুষের থুতু ফেলতো আজ তার লালন পালন করেই মান্তু বড় ধরনের ছাগল প্রেমিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন।
মির্জাপুরের সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই কাশির কষ্ট পাওয়া মানতু আজ কেবল একজন খামারি নয়, সে পূর্ব পাড়ার উন্নয়নের এক জীবন্ত প্রতীক।
সংস্কার কৃত।
আরো আসছে—–

🖋️রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
👉প্রভাষক :হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা মান্দা নওগাঁ।
তারিখ:২০/১০/২০২৫
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL ISLAM.