✂️ছোট গল্প: কাঁচির লাইসেন্স
(গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে রচিত একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প)
রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌺
তারিখ:২৬/১০/২০২৫
সকালবেলা গ্রামের মেঠোপথে হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। পুব আকাশে সূর্যের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে ধীরে ধীরে। বাতাসে ধানের গন্ধ—সেই পাকা ধানের, যেটা মানুষকে প্রাণের তাগিদে মাঠে টেনে নিয়ে যায়। চারদিকে গাছগাছালি, দূরে দেখা যায় নদীর ধারে কুয়াশার আস্তরণ, যেন নরম সাদা চাদরে মোড়ানো কোনো নিসর্গচিত্র। পাখিরা চঞ্চল হয়ে ডাকছে—কেউ কুজন তুলছে তালগাছের মাথায়, কেউ উড়ে যাচ্ছে নদীর ওপারে।
আমি সেদিন যাচ্ছিলাম উল্লাপাড়া সড়ক দিয়ে সিরাজগঞ্জের থেকে রাজশাহী শহরের দিকে। পথের ধারে এক লোককে দেখলাম—হাতে ঝকঝকে একটি কাঁচি, পরানের শার্ট। তার মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চোখে ছিল দৃঢ়তা। মনে হলো, এই মানুষটি জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছেন।
আমি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললাম,
—ভাই, কোথায় যাচ্ছেন?
লোকটি একটু হেসে তাকালেন আমার দিকে। তার দাঁতের ফাঁকে রোদ পড়ে চকচক করল। বললেন,
—যাই কাজের খোঁজে, ভাই।
আমি আবার জানতে চাইলাম,
—কোথাকার মানুষ আপনি?
—আমি উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জের লোক, ভাই।
তারপর আমার দৃষ্টি গেল হাতে ধরা কাঁচির দিকে। সেই কাঁচি যেন ঝলমল করছিল সকালের সূর্যালোকে। কৌতূহল হলো। বললাম,
—এই কাঁচিটা হাতে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
লোকটি একটু হেসে বলল,
—কাঁচিটা দেখেই তো বোঝা যায়, আমি কোথায় যাচ্ছি! এটাই আমার লাইসেন্স, ভাই।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
সে বোঝাতে লাগল—
—দেখেন ভাই, পুলিশের হাতে থাকে বন্দুক, সেটার আবার লাইসেন্স লাগে। শিক্ষকের হাতে থাকে কলম, সেটাই তার পরিচয়। ছাত্রদের থাকে আইডি কার্ড। ব্যবসায়ীর দোকানে থাকে নামফলক। কিন্তু আমরা যারা মাঠে ধান কাটি, আমাদের তো এসব কিছুই নাই। আমরা বই লিখি না, পড়াই না, দোকানও চালাই না। তাই আমাদের পরিচয় এই কাঁচি। এটিই আমাদের “ধান কাটার লাইসেন্স”। শুনে হাসি পেল তবুও মন ভরে উঠলো কৃষকের এই দৃঢ়তার স্বপ্ন দেখে। আমার গাঁয়ের মনটু বাবুর্চির মত তার গঠন দেখতে হুবহু প্রায় একই রকম মনে হলো। কথায় কথায় বলেই ফেললাম যে মন্টু বাবুর্চি রামপুরা ঢাকা নগরীতে বউবাজার এলাকায় কাজ করে দেখতে আপনার মতই চেহারা।
তার চোখে তখন এক ধরনের গর্বের ঝিলিক।
—যখন আমি মাঠে ঢুকি, দূর থেকেই মানুষ চিনে ফেলে—‘ওই যে কাটাওয়ালা ভাই আসছে’। কেউ জল দেয়, কেউ ভাত দেয়, কেউ ডাকে মাঠে সাহায্যের জন্য। আমাদের পরিচয় আমাদের হাতে ঝলমল করা এই কাঁচি। এটাই আমার সম্মান, এটাই আমার জীবিকা।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ভাবছিলাম—কত সরল এই মানুষের জীবন, অথচ কত গভীর তার চিন্তা! তার কাছে জীবনের মানে হলো পরিশ্রম, আর সেই পরিশ্রমের প্রতীক হলো কাঁচি।
আমাদের বাস চলতেছিল রাজশাহী শহরের দিকে। দেখতেছিলাম দেখতেছিলাম চারপাশে ছিল সোনালী ধানের ঢেউ, হাওয়ায় দুলছে ধানের শীষ। দূরে দেখা যায় নদীর ধারে কিছু ছেলে সাঁতার কাটছে। নদীর পানি স্বচ্ছ, তাতে সূর্যের আলো পড়ে রুপালি ঝিলিক দিচ্ছে। পাশেই একটা পাকা ঘাট, সেখানে কয়েকজন নারী কলসি ভরে পানি নিচ্ছে, কেউ ধান ধুচ্ছে। নদীর তীরে একদল বক দাড়িয়ে আছে ধ্যানমগ্ন হয়ে। নাটোরের নানান ধরনের খেজুরের বাগান ও কাশি কাঁটা এলাকায় একটি দোকান ও নানান ধরনের গাছপালা। কথায় কথায় কথা হল এক মুরব্বির সাথে মুরুব্বী আমাকে বললেন শীতের সকালে নাটোরের কাশি কাটার এলাকায় খেজুরের রসের দেখা মেলে। কথায় কথায় বলেই ফেললাম আবার আসার সময় শীতের সকালে নাটোরের কাশি কাটা থেকে খেজুরের রস খেয়ে যাব। লোকটিকে দেখে মায়া হচ্ছিল আর মনে পড়ছিল হরিপদ কাঁপালীর সেই হরিদানের কথা তার প্রচেষ্টার সাধনায় আজকে সে হরিপদ কাপালি হরিদানের আবিষ্কার হতে পেরেছে। লোকটির দিকে তাকিয়ে মনে হলো সে আজকে কাঁচির লাইসেন্স নিয়েই বিখ্যাত কাচির লাইসেন্সওয়ালা লোক হতে চায়।
লোকটি নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,
—এই নদী আমাদের জীবন, ভাই। এই নদী না থাকলে মাঠে পানি আসত না, ধানও হতো না। কাঁচিও হত অকাজের। নদী শুকিয়ে গেলে আমাদের জীবনের আলোও শুকিয়ে যাবে।
আমি তার কথায় গভীর সত্য দেখলাম। প্রকৃতি, পরিশ্রম আর মানুষ—সব একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। এই কাঁচিও যেন সেই সম্পর্কের প্রতীক।
আমরা আরও কিছু দূর এগোলাম। গ্রামের মানুষ তখন কাজে ব্যস্ত। কেউ মাঠে যাচ্ছে পাটি ছাগল নিয়ে, কেউ হাল ধরেছে, কেউ আবার ঝুড়ি মাথায় সবজি নিয়ে বাজারের পথে। একদল মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে নীল ওড়না উড়িয়ে। গ্রামের জীবন যেন চলমান এক কবিতা। আবার কখনো কখনো দেখা মিলল রাস্তার দুই ধারে সাইনবোর্ডগুলোতে শুটকি মাছের ছবি ও ডাব এমনকি নানান ধরনের খাবারের তালিকা। আহ সেই শুটকি মাছের স্বাদ ভুলেই গিয়েছিলাম পেয়েছিলাম তেলাপিয়া মাছ ,পাঙ্গাস আরও দেশীয় অনেক মাছ তবে একটি কথা না বললেই নয় সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে নানান ধরনের মাছের সমাহার আজও দেখা যায়। সেই চলতে চলতে মনে পড়ছিল মায়ের আদর সোহাগ আর ছাগল পালনের সেই ইতিহাস গুলো । 🐐 ছাগল একটু বড়ই কুজাত ধরনের হয়ে থাকে। বিশেষ করে পাটি ছাগলগুলো। আর কালক্রমে মহিষের সমাহার কমে গেছে বলেই মনে হয়।
হঠাৎ লোকটি থেমে বলল,
—এই যে ভাই, ওখানে দেখেন ওই ধানের ক্ষেতটা! আজ নাটোরের কাশি কাটাতেই নেমে যাব সেখানেই কাজ শুরু করব। সকালে এই প্রত্যাশা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। মালিকের ডাকে যে মালিক রিজিকের সন্ধান দেয় আমাদের সেই প্রভুর ভরসা করে আমরা চলি। কুষ্টিয়ার তিলের খাজার কথাও তার মুখে শুনতে পেলাম বড় ভালো লাগলো। লোকটি একটু তোতলা গলায় আই -য়েপ ভাই আমি বললাম আরে ভাই বলেন আই -য়েপ ভাই এটা কি?রাস্তায় অনেক কাদাবালি থাকে তার মুখে শুনতে পেলাম গ্রামের রাস্তাগুলো আসলেই অনেক কাদাবালি পড়ে থাকে বর্ষার সময় এই কাদাবালিতে তাদের চলাচল কষ্ট হয়ে যায়। তারপর সে নেমে গেল নেমে যাওয়ার সময় বলতেছিল তার সেই কিছু কাজের বিবরণ-কাজ করার সময়।
সে একটু দাঁড়িয়ে পায়ের নিচের মাটি ছুঁয়ে মাথায় ছোঁয়াল,এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্মরণ করে বলে এই মাটি থেকেই দান উৎপন্ন হয় এই মাটি থেকেও আমি জন্ম নিয়েছি আবার আমি এই মাটিতেই মিশে যাব কিসের এত অহংকার আমি কাচিওয়ালা কাঁচি নিয়েই আমার খেলা। তারপর কাঁচিটা কোমরে গুঁজে বাসের ভিতর থেকে নাটোর নেমে গেল।
আমি বাস থেকে তাকিয়ে রইলাম তার পিছুপিছু। রোদ পড়ে তার শরীরে, কাঁচি ঝলমল করছে, আর সে ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে ধানের সোনালী সমুদ্রে। মনে হচ্ছিল, যেন এক নীরব যোদ্ধা, জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে নামছে অস্ত্র হাতে—তার অস্ত্র কাঁচি, তার যুদ্ধ বেঁচে থাকার।
হঠাৎ আমার মনে পড়ল তার সেই কথাগুলো—
“শিক্ষকের হাতে কলম, পুলিশের হাতে বন্দুক, আর কৃষকের হাতে কাঁচি—সবাই নিজের নিজের লাইসেন্স নিয়েই জীবনযুদ্ধ করে।”
সেদিন আমি বুঝেছিলাম, প্রতিটি মানুষেরই একটি করে ‘লাইসেন্স’ আছে—যেটা তার পরিশ্রম, তার সম্মান, তার পরিচয়। কেউ কলম দিয়ে শিক্ষা ছড়ায়, কেউ বন্দুক দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষা করে, কেউ আবার কাঁচি হাতে পৃথিবীকে খাওয়ায়।
সন্ধ্যায় ফিরে আসার সময় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। লালচে আলো নদীর জলে গলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল সেই মানুষটির মুখ—তার কাঁচি, তার গর্ব, আর তার অমলিন হাসি। মনে হলো, এই দেশ টিকে আছে সেই কাঁচিওয়ালা মানুষের ঘামে, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে।
আমি মনে মনে বললাম—
“তুমি গর্ব করো ভাই, তোমার কাঁচিই তো এই দেশের জীবনের চাকা ঘোরায়। তোমার হাতে যে কাঁচি, সেটাই আমাদের জীবনের লাইসেন্স।”
🗡️শেষ কলমে,
✍️মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🖋️রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
©️তারিখ:২৬/১০/২০২৫
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL ISLAM.