গল্প: মর্যাদার মাপকাঠি(ঠ্যাং এর নিচে)
লেখক: মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
তারিখ:২৭/১০/২০২৫
গ্রামের নাম সোনারগাঁও। ছোট্ট গ্রাম হলেও সেখানে এখন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পুরনো দিনের কুসংস্কার আর অজ্ঞতার দেয়াল ভাঙতে শুরু করেছে। তবুও কিছু কিছু পুরনো ধারণা এখনো মানুষকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে—বিশেষত নারী নিয়ে সমাজের ভুল ধারণা।
এই গ্রামেরই মানুষ সলিমুদ্দিন। মুখে একটু তোতলামি আছে, তাই সবাই তাকে ডাকে “তোতলা সলিমুদ্দিন” নামে। ছোটবেলায় সে দাদার কাছ থেকে শুনেছিল এক কথাই—
“নারীর স্থান দুই ঠ্যাঙের নিচে।”
দাদা এই কথাটা এমনভাবে বলতেন, যেন এটাই চিরন্তন সত্য। সলিমুদ্দিনও বড় হয়ে সেই কথাটাকেই জীবনের একমাত্র দর্শন বানিয়ে ফেলল।
তার স্ত্রী রোকেয়া শান্ত, পরিশ্রমী ও ঈমানদার নারী। ঘর সামলায়, সন্তানকে পড়ায়, স্বামীকে সম্মান দেয়—সব দিক থেকেই সে এক আদর্শ স্ত্রী। তবুও সলিমুদ্দিন মাঝে মাঝে হুকুমের সুরে বলে ওঠে,
“শোনছো রোকেয়া, আমরা না পুরুষ, তোমরা নারী। তোমাদের স্থান দুই ঠ্যাঙের নিচে।”
রোকেয়া চুপ করে যায়। কারণ, সে জানে কথা বললে বাড়ির শান্তি নষ্ট হবে। কিন্তু মনের ভেতর কষ্টের ঢেউ খেলে যায়।
১. রেবেকার গল্প
সলিমুদ্দিনের পাশের বাড়ির মেয়ে রেবেকা। সলিমুদ্দিনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। রেবেকার বাবা সলিমুদ্দিনের চাচাতো ভাই সলিমুল হক—গ্রামেরই একজন শিক্ষিত মানুষ। তার মেয়ে রেবেকা দেখতে অপরূপা। গালে একটি ছোট্ট তিল, যেন সৌন্দর্যের এক অনিন্দ্য চিহ্ন।
ছোটবেলা থেকেই সে মেধাবী, আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কিন্তু একদিন সে শুনল তার এক প্রতিবেশী তাকে নিয়ে বলছে,
“মেয়ে হয়ে আবার বেশি পড়াশোনা করছে! এদের নাকি স্বপ্ন চাকরি করবে, গাড়িতে চড়বে! নারী জাতি কই গিয়া কবে পুরুষ হবে নাকি!” তারা মাটির তৈরি সোনার টিখির ভিতরে খড়ি বা লাকড়ি ঢুকাবে।
এই কথাগুলো রেবেকার মনে এক ধরণের জেদ তৈরি করে দিল। সে ভাবতে শুরু করল, “নারী বলেই কি আমি ছোট? আমিও পারি, পুরুষের চেয়ে ভালো কাজ করতে পারি।”
তখন থেকেই রেবেকা নিজেকে বদলাতে শুরু করল। ছেলেদের মতো পোশাক পরতে লাগল, কণ্ঠে আনল কঠোরতা, আর আচার-আচরণে দেখাতে লাগল সে ‘পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’।
তার বাবা সলিমুল হক প্রথমে মৃদু হেসে বলেছিলেন,
“মেয়ে, আত্মসম্মান ভালো জিনিস, কিন্তু নারী হবার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই।”
কিন্তু রেবেকা তখন শুনল না। তার মনে তখন একটাই ধারণা—পুরুষের সমান নয়, বরং তাদের চেয়ে বড় হতে হবে। আর পুরুষটা চারটা বিয়ে করলে আমরা কেন চারটা পারবো না কিন্তু তার এই জ্ঞান ছিল না সে শুধু দাম্ভিকতার আধুনিকতার ও পশ্চিমা সভ্যতার করালগ্রাসে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল।
২. আলেমের আগমন
একদিন গ্রামের মসজিদে ঘোষণা এল—“আগামী শুক্রবার সোনারগাঁও মসজিদে আসছেন প্রখ্যাত আলেম মাওলানা অনুপম হোসেন। তিনি ইসলাম ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে বয়ান দেবেন।”
মাওলানা অনুপম হোসেন ছিলেন দেশের খ্যাতনামা বক্তা। তার বয়ানে এমন এক প্রভাব ছিল, যা অন্ধকার মনেও আলো জ্বালাতে পারত।
শুক্রবার বিকেলে মসজিদ প্রাঙ্গণে ভিড় জমল। পুরুষ, নারী, যুবক, বৃদ্ধ—সবাই হাজির। মহিলাদের জন্য আলাদা পর্দার ব্যবস্থা ছিল। রেবেকাও এল, একটু দূরে বসে শোনার জন্য।
মাওলানা অনুপম হোসেন শুরু করলেন শান্ত কণ্ঠে,
“ভাই ও বোনেরা, আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন—
‘আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি।’
(সূরা নিসা -১)
দেখুন, আল্লাহ এখানে নারী-পুরুষকে পৃথক মর্যাদা দেননি, বরং উভয়কেই মানব জাতি হিসেবে সমান মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু দায়িত্বের ক্ষেত্র ভিন্ন—এটাই প্রজ্ঞার পরিচয়।”
তিনি থামলেন কিছুক্ষণের জন্য, তারপর বললেন—
“পুরুষের দায়িত্ব হলো পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ, উপার্জন, নেতৃত্ব প্রদান। আর নারীর দায়িত্ব হলো সন্তানকে লালন, ভালোবাসা ও নৈতিকতায় মানুষ করে গড়ে তোলা। উভয়েই একে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।”
মসজিদ প্রাঙ্গণে নীরবতা নেমে এল। সবাই যেন নতুন কিছু শুনছে।
তিনি আবার বললেন,
“কেউ যদি বলে, নারীর স্থান দুই ঠ্যাঙের নিচে—তবে সে ইসলামের চরম অবমাননা করছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তো বলেছেন,
✓আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের মাঝে সে-ই ভাল যে তার পরিবারের নিকট ভাল। আর আমি আমার পরিবারের নিকট তোমাদের চাইতে উত্তম। আর তোমাদের কোন সঙ্গী মৃত্যুবরণ করলে তার সমালোচনা পরিত্যাগ করো।
জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩৮৯৫
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
এ কথাগুলো শুনে রেবেকার মন কেঁপে উঠল। যেন তার অন্তরের অন্ধকারে কেউ আলো জ্বেলে দিল। একজন নারী চারজন স্বামী রাখা আল্লাহ বৈধ রাখেন এবং কি সন্তান কার হল তা নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভালো জানেন এর কারণ সুতরাং আল্লাহর হুকুম মানি আল্লাহর পথে চলি।
৩. রেবেকার জাগরণ
বয়ান শেষে রেবেকা নিঃশব্দে ঘরে ফিরে গেল। রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাল।
সে ভাবল, “আমি কেন নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করতে চাইছি? আমি নারী—এটাই তো আল্লাহর দেয়া মর্যাদা। আমি যদি ভালো মেয়ে, ভালো মা, ভালো মানুষ হতে পারি, তাতেই তো শ্রেষ্ঠত্ব।”
পরদিন সে মাথায় ওড়না জড়াল, শালীন পোশাক পরল। গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে দেখল—রেবেকার চেহারায় এক প্রশান্তি, এক দীপ্তি।
রেবেকা নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেল, কিন্তু এখন তার লক্ষ্য বদলে গেছে। সে চায় গ্রামের মেয়েদের শিক্ষা ও আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করতে।
৪. তোতলা সলিমুদ্দিনের জাগরণ
ওদিকে সলিমুদ্দিন বয়ান শুনে বাড়ি ফিরল বেশ রাগী মুখে। রোকেয়া জিজ্ঞেস করল,
“কি হইছে গো, এত চুপ কেন?”
সলিমুদ্দিন বলল,
“এই মাওলানা না, আজ কইতেছিল নারী-পুরুষ সমান! নারীরও মর্যাদা আছে! আমার দাদি তো কইত নারীর স্থান দুই ঠ্যাঙের নিচে!”
রোকেয়া নরম কণ্ঠে বলল,
“তোমার দাদি মানুষ ছিলেন সোজা-সাপ্টা, কিন্তু সব জানতেন না। কুরআনে আল্লাহ কইছেন,
‘পুরুষদের জন্য তাদের কর্মফলের প্রাপ্যতা আছে, নারীদের জন্যও তাদের কর্মফলের প্রাপ্যতা আছে।’
(আল কোরআন)
তাহলে আল্লাহ যখন কাউকে হেয় করেননি, আমরা করব কেমন করে?”
সলিমুদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“তুমি কইতাছো, আমি ভুল?”
রোকেয়া হাসল,
“ভুল না গো, ভুল ধারণা। তুমি মানুষ ভালো, কিন্তু পুরনো কথা বিশ্বাস করে বসে আছো।”
৫. পরিবর্তনের সূচনা
পরদিন সকালে সলিমুদ্দিন রেবেকাকে দেখল গ্রামের মেয়েদের একত্র করে ইসলামী শিক্ষা দিচ্ছে—নামাজ, পর্দা, নারী মর্যাদা, আর আত্মসম্মান শেখাচ্ছে।
সে থমকে দাঁড়াল। রেবেকার চেহারায় আত্মবিশ্বাস, চোখে আলো।
সলিমুদ্দিন ধীরে ধীরে কাছে গেল।
“রেবেকা, তুই তো পুরুষদের মতো হইতে চাসছিলি, এখন দেখি নারীর কাজ করছিস?”
রেবেকা মুচকি হেসে বলল,
“চাচা, এখন বুঝেছি—নারী পুরুষের মতো হবার জন্য নয়, বরং নিজের মর্যাদা বুঝে চলার জন্য। নারীকে আল্লাহ যে মর্যাদা দিয়েছেন, সেটাই যথেষ্ট। পুরুষের পা-তলে নয়, বরং তার পাশে থেকেও নারী সম্মানিত।”
এই কথা শুনে সলিমুদ্দিনের মনে ঝড় উঠল। তার মনে পড়ল রোকেয়ার মুখ, তার মায়া, তার পরিশ্রম। হঠাৎ বুঝতে পারল—সে এতদিন কত ভুল ধারণা বুকে লালন করেছে।
৬. এক নতুন সকাল
কয়েকদিন পর, এক সকালে গ্রামের মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে সবাই দেখল সলিমুদ্দিন রোকেয়ার পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে এক মুঠো ফুল।
সে বলল,
“রোকেয়া, আমি তোতলা মানুষ, তাই মুখে ঠিক কইতে পারি না। কিন্তু আজ বলতে চাসি—তুমি আমার সম্মান, তুমি আমার অর্ধেক জীবন। আমি আজ বুঝছি, নারী কোনো পায়ের নিচে নয়, বরং আল্লাহর রহমতের ছায়া।”
রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। সে বলল,
“তুমি এ কথা কইছো, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।”
গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে দেখল সলিমুদ্দিনের এই পরিবর্তন। সেই মানুষ, যে নারীর মর্যাদা মানত না, এখন সবাইকে বলছে—
“নারীর স্থান দুই ঠ্যাঙের নিচে না ভাই, হৃদয়ের ভেতর।”
৭. সমাজের পরিবর্তন
মাওলানা অনুপম হোসেনের বয়ানের প্রভাবে সোনারগাঁও গ্রামে ধীরে ধীরে পরিবর্তন এল। মেয়েরা পড়াশোনা শুরু করল, ছেলেরা শ্রদ্ধা করতে শিখল।
রেবেকা এখন গ্রামের স্কুলে শিক্ষিকা। সে মেয়েদের শেখায়—
“সমতা মানে প্রতিযোগিতা না, বরং পারস্পরিক সম্মান।”
সলিমুদ্দিন প্রতিদিন মসজিদে যায়, আর ফিরে এসে ছেলেমেয়েদের বলে,
“আল্লাহর দুনিয়ায় নারী-পুরুষ কেউ কারো শত্রু না, বরং একে অপরের আশীর্বাদ।”
৮. শেষ প্রান্তে শিক্ষা
সময় বয়ে যায়। একদিন রেবেকা একটি বক্তৃতায় বলল,
“আমি একসময় ভেবেছিলাম পুরুষের চেয়ে বড় হতে হবে। কিন্তু আজ বুঝেছি, বড় হওয়া মানে কারো চেয়ে উঁচু হওয়া নয়, বরং নিজের মর্যাদা চিনে নেওয়া।”
সে থামল, তারপর বলল—
“আল্লাহ নারীর ভেতরে দিয়েছেন দয়া, কোমলতা, ত্যাগ ও ধৈর্য—যা দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী গুণ। যে নারী নিজের এই গুণগুলো চিনে নেয়, সে-ই প্রকৃত মর্যাদাবান।”
গ্রামের সবাই তার কথায় অভিভূত হয়ে গেল। সলিমুদ্দিন নিচু গলায় বলল,
“রেবেকা, তুই আমাদের চোখ খুলে দিছস। আল্লাহ তোকে ভালো রাখুক।”
🍌শেষ কথা
মানুষের মর্যাদা লিঙ্গে নয়, চরিত্রে। নারী-পুরুষ উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি, উভয়ই দায়িত্বশীল ও সম্মানিত। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো লিঙ্গই হীন নয়, বরং প্রত্যেকে একে অপরের সহযোগী।
যে সমাজ নারীকে পদদলিত করে, সে সমাজ ব্যাকওয়ার্ড থাকে; আর যে সমাজ নারীকে সম্মান দেয়, সে সমাজ আলোর পথে অগ্রসর হয়।
রচনায়:মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
প্রভাষক হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা মান্দা নওগাঁ।
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL Islam.
প্রকাশকঃ সবুজ হুসাইন।
সম্পাদকঃ মোঃ ইমদাদুল হক নয়ন।