উপন্যাস: বিশ্বাস ও মর্যাদার গল্প
নাটোর জেলার এক প্রাচীন গ্রাম—কাশি কাটা। গ্রামটি সবুজে ঘেরা, পাখির কলতানে মুখর, আর সকালবেলায় দূর থেকে ভেসে আসে আজানের সুমধুর ধ্বনি। এই গ্রামেই বাস করতেন টুকুন ফকির—একজন সহজ-সরল, ধর্মপ্রাণ ও পরিশ্রমী মানুষ। সারাদিন ক্ষেতের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, তবু সময়মতো নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত বাদ দিতেন না। গ্রামের মানুষ তাকে সম্মানের চোখে দেখত।
টুকুন ফকিরের সংসারে একটিই রত্ন—তার একমাত্র মেয়ে ছকিনা। ছোটবেলা থেকেই ছকিনা ছিল বুদ্ধিমতী, হাসিখুশি আর কৌতূহলী। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত সে। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখত আর বলত, “বাবা, আল্লাহ কি এই সূর্যের মতোই সবকিছু আলোকিত করে দেন?” টুকুন ফকির হেসে বলতেন, “হ্যাঁ মা, যার অন্তরে ঈমানের আলো জ্বলে, তার জীবনে কখনো অন্ধকার থাকে না।”
ছকিনার পড়াশোনার পাশাপাশি ছিল এক অদ্ভুত শখ—হাফ টোস্ট খাওয়া। গ্রামের হাটে একমাত্র মুদি দোকানেই মিলত এই হাফ টোস্ট। শুকনো, হালকা মিষ্টি স্বাদের টোস্টের সঙ্গে চা হলে যেন তার বিকেলটা পূর্ণ হতো। প্রথমে নিজের জন্য কিনত, পরে সে ভাবল—“আমি একা কেন খাবো? আমার বন্ধুদেরও খাওয়াতে পারি!”
সেই থেকে ছকিনা যখনই স্কুলে যেত, ব্যাগে দু’তিন প্যাকেট হাফ টোস্ট রাখত। টিফিনের সময় খুলে বলত,
—“চলো, সবাই খাই! ভাগ করে খেলে আনন্দ বেশি।”
বন্ধুরা হাসত, কেউ বলত—“দেখো, আমাদের টোস্টওয়ালি ছকিনা এসেছে!”
ছকিনা হেসে বলত, “হোক না টোস্টওয়ালি, অন্তত সবার মুখে হাসি আনতে পারি!”
এইভাবেই গ্রামের মেয়েদের মধ্যে সে হয়ে উঠল প্রিয় মুখ। কেউ তাকে ভালোবেসে ডাকত ‘টোস্ট আপা’, কেউ ‘ছকিনা আপা’।
কিন্তু সুখের দিন বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
একদিন ছকিনা দোকানে গিয়ে দেখল, যে টোস্ট একসময় ৫০ টাকায় কেজি পাওয়া যেত, তা এখন ১০০ টাকা কেজি!
ছকিনা অবাক হয়ে বলল,
—“এই যে ভাই, হঠাৎ এত দাম কেন?”
দোকানদার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—“কি আর করবো আপা! মালামাল ঢুকতেই দেরি, উপরে আবার দালাল চক্র। দামে চাপ দিচ্ছে!”
ছকিনা অবাক হয়ে বলল, “মানে? টোস্টের দালালও আছে নাকি?”
দোকানদার হেসে উত্তর দিল, “আজকাল তো সবকিছুতেই দালাল আছে আপা—চাল, ডাল, তেল, এমনকি টোস্টেও!”
সেদিন ছকিনা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
তার ছোট্ট মনটা ভাবল, “যে দেশে খাবারেও দালাল বসে যায়, সে দেশের সাধারণ মানুষ বাঁচবে কীভাবে?”
ছকিনা এরপর থেকে টোস্ট কেনা কমিয়ে দিল।
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে বলত, “দালালি বেড়ে গেছে, আর টোস্ট খেতে মন চায় না।”
বন্ধুরা হাসত, কেউ কেউ ঠাট্টা করত, “দেখো, টোস্টওয়ালি ছকিনা এখন রাজনীতি বোঝে!”
কিন্তু ছকিনার চোখে হাসি থাকলেও মনে একটা কষ্ট ঘুরপাক খেত।
💐 সিঙ্গারার দিনগুলো
টোস্টের জায়গা নিল সিঙ্গারা।
স্কুলের ক্যান্টিনে এক টাকার সিঙ্গারা ছিল ছেলেমেয়েদের প্রিয় খাবার।
ছকিনাও ভাবল, “চল, টোস্টের বদলে এখন থেকে সিঙ্গারা খাই।”
প্রথম প্রথম মজা লাগল, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সিঙ্গারার দামও বেড়ে গেল।
যে সিঙ্গারা এক টাকায় পেত, তা এখন পাঁচ টাকা, পরে দশ টাকা পিস!
সে হাসতে হাসতে বলল,
> “হাফ টোস্টে দালালি ছিল, এখন দেখি সিঙ্গারাতেও দালালি ঢুকে গেছে!”
বন্ধুরা আবার হেসে উঠল। কিন্তু এবার হাসির মধ্যে একটা চিন্তার ছায়া ছিল।
সবাই বুঝতে শুরু করল—দালালি যেন সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে।
✍️শিক্ষাজীবনের পথ
ছকিনা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলো, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গ্রামের মেয়ে শহরে এসে প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু পরিশ্রমে আর সততায় নিজের জায়গা করে নিল।
তার একটাই নীতি ছিল—“সৎ থাকো, অন্যায় দেখলে চুপ থেকো না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সে অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো।
ভর্তি ফরমের জন্য অতিরিক্ত টাকা চাওয়া হলো—
সে অবাক হয়ে বলল, “এত ফি কেন?”
জবাব এল, “আপনি চাইলে কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, তবে একটু কিছু দিতে হবে।”
ছকিনা ঠাণ্ডা গলায় বলল,
> “এটাও দালালি। এই দালালির জন্যই তো আমাদের সমাজ পিছিয়ে আছে।”
বন্ধুরা তাকে বলত, “তুমি বদলাতে পারবে না ছকিনা, এ দেশ এমনই।”
কিন্তু ছকিনা দৃঢ় কণ্ঠে বলত,
> “যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, ততক্ষণ পরিবর্তনের আশা থাকে।”
🍌 জীবনের নতুন অধ্যায়
বছর কয়েক পর ছকিনা উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরি পেল—একটি সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা।
সেদিন প্রথম বেতন হাতে পেয়ে তার মনে পড়ল পুরনো কথা।
চোখে ভেসে উঠল গ্রামের হাট, দোকানের হাফ টোস্ট, বন্ধুরা আর সেই হাসিখুশি দিনগুলো।
বেতন পাওয়ার আনন্দে একদিন সে বাজারে গেল। পুরনো স্মৃতি ফিরে পেতে দোকানে গিয়ে বলল,
—“ভাই, হাফ টোস্ট দিবেন একটু?”
দোকানদার তাকিয়ে বলল,
—“আছে আপা, তবে দাম একটু বেশি।”
—“কত?”
—“দেড়শ টাকা কেজি।”
ছকিনার বুকটা ধক করে উঠল।
সে নিঃশব্দে টোস্টের প্যাকেট হাতে নিল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল,
> “এই টোস্টই একদিন ৫০ টাকায় খেতাম। আজ দেড়শ টাকায় কিনছি।
সময় বদলেছে, দাম বেড়েছে, কিন্তু দালালদের রাজত্ব এখনো শেষ হয়নি।”
বাড়ি ফিরে জানালার ধারে বসে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তার চোখে ভেসে উঠল সমাজের বাস্তব চিত্র—
হাসপাতালে ওষুধে দালালি, শিক্ষায় দালালি, পশুর হাটে দালালি, এমনকি ন্যায়বিচারেও দালালি!
সে ভাবল, “এই দালালরা যেন দেশের শিরা-উপশিরায় রক্তের মতো ছড়িয়ে গেছে।”
💐 পরিবর্তনের স্বপ্ন
ছকিনা এখন গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সে শুধু অক্ষর শেখায় না, শেখায় সততা, ঈমান ও নৈতিকতা।
প্রতিদিন সকালবেলায় ক্লাসের শুরুতে সে এক কথা বলত—
> “বাবারা, তোমরা মানুষ হবে, কিন্তু আগে সৎ মানুষ হতে শিখবে।”
একদিন এক ছাত্র জিজ্ঞেস করল,
—“ম্যাডাম, দালাল কাকে বলে?”
ছকিনা একটু থেমে উত্তর দিল,
> “যে অন্যের কষ্টে নিজের লাভ খোঁজে, সে-ই দালাল।
যে অন্যের প্রাপ্য কেড়ে নেয়, সে দালাল।
আর যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, সেও অজান্তে দালালি করে।”
ক্লাসে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।
ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারল—দালালি শুধু বাজারে নয়, মানুষের চরিত্রেও ঢুকে পড়ে।
সন্ধ্যায় স্কুল শেষে ছকিনা হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে গেল।
পাখিরা ফিরছে বাসায়, আকাশে লাল সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
সে ধীরে ধীরে বলল,
> “হে আল্লাহ, এই দেশটা বদলে দাও। মানুষের হৃদয়ে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দাও।”
🍯 টোস্টের প্যাকেট
বছরের পর বছর কেটে গেল।
একদিন তার এক ছাত্রী স্কুল শেষে অফিসে এসে বলল,
—“ম্যাডাম, আপনার টেবিলের ড্রয়ারে এই পুরনো টোস্টের প্যাকেটটা কেন রাখেন?”
ছকিনা মৃদু হেসে বলল,
> “এটা শুধু টোস্ট নয়, এটা আমার জীবনের গল্প।
যখন এই টোস্টের দাম ৫০ টাকা ছিল, আমি ভেবেছিলাম সুখ মানে ভাগাভাগি করা।
কিন্তু যখন দাম ১০০ টাকায় উঠল, বুঝলাম—সুখ কেড়ে নেয় দালালি।
আর আজ যখন দেড়শ টাকায় কিনি, তখন ভাবি—
আল্লাহ্র ভয় হারালে সমাজে শুধু দালালই রাজত্ব করে।”
ছাত্রীটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ছকিনা বলল,
> “এই টোস্ট আমাকে শিখিয়েছে—অসততা যত ছোটই হোক, তা একদিন সমাজকে গ্রাস করে।
তাই সৎ থেকো, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করো।
কারণ নীরবতা মানেই অন্যায়ের পক্ষ নেওয়া।”
🌺 নৈতিক জাগরণ
সেদিন সন্ধ্যায় মসজিদের মাইকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো।
ছকিনা জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকাল।
তার মুখে এক শান্ত হাসি, চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
সে মনে মনে বলল,
> “মানুষ যদি ঈমান হারায়, তাহলে দালালরাই রাজা হবে।
কিন্তু যদি মানুষ আল্লাহর ভয় ফিরে পায়, তাহলে এই দালালি একদিন শেষ হবে।”
সেদিন রাতের চাঁদের আলোয় ছকিনা তার পুরনো ডায়েরিতে লিখল—
“দালালদের সমাজে ঈমান টিকে থাকে না।
কিন্তু একজন সৎ মানুষই পারে হাজার অসৎকে হার মানাতে।
তাই পরিবর্তন শুরু হোক আমার ভেতর থেকেই।”
💐 শেষ দৃশ্য
বছর পেরিয়ে যায়।
ছকিনা এখন প্রায় অবসরপ্রাপ্ত।
স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এক ছাত্র মঞ্চে উঠে তার নামে গান গাইছে—
“টোস্টওয়ালি ম্যাডাম, আপনিই আমাদের আলো।”
সবাই হাসছে, করতালি দিচ্ছে।
ছকিনার চোখ ভিজে যায় আনন্দে।
বাড়ি ফিরে টেবিলে বসে পুরনো টোস্টের প্যাকেটটা হাতে তুলে নেয়।
একটু তাকিয়ে থাকে, তারপর আস্তে করে বলে,
> “তোদের ছোঁয়া আছে এতে—আমার শৈশব, আমার শিক্ষা, আমার সমাজ।”
সে চোখ বন্ধ করে দোয়া করে—
> “হে আল্লাহ, আমার দেশকে দালালদের হাত থেকে মুক্ত করো।
মানুষের অন্তরে সততার আলো জ্বালাও।
যেন কোনো শিশুর মুখে আর বলতে না হয়—সবকিছুতেই দালালি।”
জানালার বাইরে তখন ভোরের আলো ফুটছে।
দিগন্তে সূর্যের কিরণ উঠছে নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
ছকিনা ধীরে ধীরে বলল,
> “একদিন আসবে, যখন মানুষ সৎ হতে গর্ববোধ করবে,
আর দালালরা লজ্জা পাবে নিজেদের চেহারা দেখাতে।”
তার ঠোঁটে শান্তির হাসি ফুটে ওঠে।
সে মনে মনে পড়ে—
> “إِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِينَ” — নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গী।
আর এই বিশ্বাসেই সে আবার জানালার দিকে তাকায়—
সামনে নতুন প্রজন্মের শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে, হাতে বই, মুখে হাসি, চোখে স্বপ্ন।
ছকিনা বুঝতে পারে—
পরিবর্তন শুরু হয়েছে, ধীরে হলেও আসছে।
কারণ যতদিন একজন মানুষ সৎ থাকে,
ততদিন সমাজে আলোর প্রদীপ জ্বলে থাকে।
🖋️শেষ কলমে
🍌 মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🍯প্রভাষক হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা মান্দা, নওগাঁ।
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL ISLAM.