💐উপন্যাস : নীতিবান চোর

 

বাংলার কোনো এক সবুজ শস্যশ্যামল রাজ্যে, যেখানে চারদিকে নদী, খাল, বেলতলী বাগান আর পাখির কলতানে মুখরিত সকাল, সেই রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তের ছোট্ট একটি গ্রামে বাস করত ঘুরি মিয়া নামের এক লোক। ঘুরি মিয়া ছিল একেবারে সাধারণ মানুষ। তার বাবা ছিলেন একজন লাঙলচাষী, মা ছিলেন গৃহিণী। কিন্তু ঘুরি মিয়া যখন বড় হলো, তখন জীবনের কষ্ট যেন তার পিছু ছাড়ল না। জমি নেই, কাজ নেই, খাবার জোটে না ঠিকমতো—দু’মুঠো ভাতের জন্য তাকে কখনো বাজারে, কখনো নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতে হতো।

 

প্রথমে সে চেষ্টা করেছিল শ্রমের কাজ করতে। অন্যের জমিতে ঘাম ঝরিয়ে কাজ করত। কিন্তু তার ভাগ্যে যেন লেখা ছিল দুর্ভাগ্য। একদিন পা পিছলে কুয়ায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায় তার। তারপর থেকে ভারী কাজ আর করা যায় না। সংসারে তখন অভাবের ছায়া নেমে আসে। বউ রাবেয়া দিনরাত উপবাসে কাটায়, আর ঘুরি মিয়ার বুকের ভিতর কাঁটার মতো বিঁধে থাকে দারিদ্র্য।

 

এক রাতে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় যখন ঘুরি মিয়া পাটকাঠির আগুনে হাত সেঁকছিল, তখন তার মনে এক ভয়ংকর চিন্তা জাগল—

“মানুষ যখন খেয়ে পরে বাঁচতে চায়, তখন যদি চুরি করেও দু’মুঠো ভাত পাওয়া যায়, তাতে দোষ কোথায়?”

 

সেই থেকেই তার জীবনে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়—চুরির জীবন।

 

✓চুরিবিদ্যার ওস্তাদ

 

ঘুরি মিয়া ভাবল, যদি চুরি করতেই হয়, তাহলে ভালোভাবে শিখে করতে হবে। তাই সে রওনা দিল পাশের গ্রামে, যেখানে বাস করত একজন চোর ওস্তাদ—চুনামূল ডাকাত নামে বিখ্যাত। চুনামূল একসময় রাজ্যের সবচেয়ে নামকরা চোর ছিল। কিন্তু এখন সে বুড়িয়ে গেছে, তবু চুরিবিদ্যায় তার নাম শুনলেই গ্রামের মানুষ ভয় পায়।

 

ঘুরি মিয়া গিয়ে তার পায়ে ধরে বলল,

“ওস্তাদ, আমি ক্ষুধার কারণে চুরি করতে চাই। আপনার কাছে চুরিবিদ্যা শিখতে এসেছি।”

 

বৃদ্ধ চুনামুল প্রথমে হেসে ফেলল, তারপর বলল,

“চুরি করা সহজ নয় রে বাপ! চোর হতে গেলে মনের মধ্যে থাকতে হবে বুদ্ধি, ধৈর্য, আর নীতি।”

 

ঘুরি মিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “চোরের আবার নীতি কী?”

 

ওস্তাদ তখন বলল তিনটি অমূল্য কথা—

১. যার উপকার করবি, তার বাড়িতে কোনোদিন চুরি করবি না।

২. যে সবসময় নিজের স্ত্রীর কথা শোনে, তার বাড়িতে চুরি করবি না।

৩. কৃপণের বাড়িতে কখনো চুরি করবি না।

 

এই তিনটি উপদেশের সাথে ওস্তাদ তাকে শিখিয়ে দিল কিভাবে নিঃশব্দে দরজা খোলা যায়, কীভাবে রাতের অন্ধকারে পদচিহ্ন মুছে ফেলা যায়, আর কিভাবে ধরা না পড়ে পালাতে হয়।

ঘুরি মিয়া তখনও জানত না, এই তিনটি নীতিই একদিন তার জীবন বদলে দেবে।

 

🍌প্রথম চুরির রাত

 

এক চাঁদনি রাতে, নদীর ধার দিয়ে কুয়াশা ভেসে আসছে, চারদিক নিস্তব্ধ। দূরে বকপক্ষীর ডাকে ভেসে আসে গাঁয়ের নিঃসঙ্গতা। ঘুরি মিয়া তখন প্রথম চুরির উদ্দেশ্যে বের হলো। সে শুনেছিল গ্রামের সবচেয়ে ধনী মানুষ রিপন কৃপণ। তার বাড়ির উঠানে ধানের গোলা ভরা, ঘরে সোনা রূপোর পসরা, অথচ সে এক পয়সা কারো দান করে না।

 

ঘুরি মিয়া চুপিচুপি রিপনের উঠানে ঢুকে পড়ল। ঘর অন্ধকার, শুধু বাতাসে ধানভাজার গন্ধ ভাসছে। সে যখন জানালার ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকাল, তখন এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখল—কৃপন রাগে নিজের ছোট ছেলেকে চড় মারছে। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে,

“বাবা, আমি তো মাত্র একটা পয়সা নিয়েছিলাম মিষ্টি কেনার জন্য।”

কিন্তু কৃপন তখন ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠি তুলে ছেলেকে এমন আঘাত করল যে, সে নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

 

ঘুরি মিয়ার বুক কেঁপে উঠল। সে মনে পড়ল ওস্তাদের সেই উপদেশ—“কৃপণের বাড়িতে চুরি করবি না।”

সে বুঝল, যে মানুষ নিজের ছেলেকে এক পয়সার জন্য মেরে ফেলতে পারে, তার ঘরে আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ বাস করে।

চুপচাপ ঘুরি মিয়া সরে এল, আর কখনো রিপনের বাড়িতে ফেরেনি।

 

ভোরে যখন গাঁয়ের মানুষ জানতে পারল কৃপনের ছেলে নেই, তখন সে বলে বেড়াল, “চোর এসে আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে।”

কিন্তু সত্যটা জানত শুধু ঘুরি মিয়া আর আল্লাহ।

 

🐸দ্বিতীয় চেষ্টায় ব্যর্থতা

 

দ্বিতীয় রাতে ঘুরি মিয়া গেল গ্রামের পাশের পুকুরের ধারে, যেখানে থাকত বইয়ের গোলাম নামে এক লোক। এই মানুষটি সারাদিন বই পড়ে, রাতে স্ত্রীর কথামতো ঘরের কাজ করে, মসজিদে নামাজ পড়ে। লোকজন বলে—“গোলাম ভাই বউয়ের কথাই শেষ কথা।”

 

ঘুরি মিয়া ভাবল, “এত ভালো মানুষ, হয়তো একটু সম্পদ আছে।”

কিন্তু যখন সে উঠানে ঢুকে ঘরের দিকে এগোচ্ছে, তখন শুনতে পেল ভিতর থেকে স্ত্রী বলছে—

“আজ রাতে দরজা ভালো করে বোল্ট দিয়ে দিও, আমি ভয় পাচ্ছি।”

আর গোলাম মুচকি হেসে বলল, “তুমি বলছো তো তাই করছি প্রিয়।”

 

ওস্তাদের দ্বিতীয় উপদেশ মনে পড়ে গেল ঘুরি মিয়ার—“যে বউয়ের কথা শুনে, তার বাড়িতে চুরি করবি না।”

সে থেমে গেল। নিঃশব্দে আবার ফিরে এল নিজের ঘরে।

 

রাবেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

“হাত খালি ফিরলে?”

ঘুরি মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“বউ, আজও পারলাম না। মনে হয় আল্লাহ চাইছেন আমি চুরি না করি।”

 

💐শেষ রাতের ঘটনা

 

তৃতীয় রাতে ঘুরি মিয়া স্থির করল, এবার রাজার প্রাসাদে যাবে। ভাবল, “রাজা তো ধনী, তার কিছু নিলেও কারো ক্ষতি হবে না।”

 

চাঁদের আলোয় নদীটা ঝিকমিক করছে, বাতাসে কাশফুল দুলছে। প্রাসাদের সামনে পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেল—চারদিকে সৈন্য পাহারা দিচ্ছে, তবু অন্ধকারে কিছুটা ফাঁকা জায়গা খুঁজে সে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে পড়ল।

 

ভিতরে ঢুকে সে এক কোণে লুকিয়ে রইল। হঠাৎ তার কানে এলো ফিসফিস শব্দ—দুজন চাকর কথা বলছে,

“আজ রাতে নাকি এক বিষধর সাপ রাজামশাইকে দংশন করবে। জ্যোতিষীরা তাই বলেছে!”

 

ঘুরি মিয়ার মনে কৌতূহল জাগল। সে নীরবে রাজকক্ষের পাশে গিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর পরদার আড়াল থেকে দেখতে পেল—একটি কালো সাপ ধীরে ধীরে রাজামশাইয়ের বিছানার দিকে এগোচ্ছে!

এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘুরি মিয়া লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক আঘাতে সে সাপটিকে মেরে ফেলল।

 

রাজামশাই জেগে উঠে হতভম্ব হয়ে তাকালেন।

“কে ওখানে?”

ঘুরি মিয়া ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। শুধু পেছনে রইল মৃত সাপ আর অজানা এক রহস্য।

 

✍️রাজ্যের হুলস্থুল

 

পরদিন সকালে রাজ্যজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল—

“রাজামশাইকে বিষধর সাপ দংশন করতে পারত, কিন্তু কেউ একজন রাতে সেই সাপ মেরে রাজাকে বাঁচিয়েছে!”

 

রাজা ঘোষণা দিলেন—

“যে ব্যক্তি এই কাজ করেছে, সে যদি নিজে এসে স্বীকার করে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু প্রমাণ দিতে হবে যে সাপটি সে-ই মেরেছে।”

 

অনেকেই দাবিদার হয়ে এল, কিন্তু কেউ প্রমাণ দিতে পারল না। ঘুরি মিয়া তখন চুপচাপ বসে ভাবছিল, “আমি তো চুরি করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আল্লাহর কুদরতে রাজাকে বাঁচালাম। হয়তো এটাই আমার জন্য হিদায়াত।”

 

🌺স্বীকারোক্তি ও পুরস্কার

 

শেষমেশ এক সকালে ঘুরি মিয়া সাহস করে রাজপ্রাসাদে গেল। রাজামশাই সামনে বসে আছেন, পাশে মন্ত্রী আর সৈন্যবাহিনী।

 

ঘুরি মিয়া মাথা নিচু করে বলল,

“রাজামশাই, আমিই সেই ব্যক্তি যিনি গত রাতে প্রাসাদে ঢুকেছিলাম। সত্যি বলতে, আমি চুরি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সাপ দেখতে পেয়ে তাকে মেরে ফেলেছি।”

 

রাজা চমকে উঠে বললেন,

“তুমি তাহলে একজন চোর?”

 

“হ্যাঁ, মহারাজ,” বিনীতভাবে বলল ঘুরি মিয়া, “কিন্তু আমি চুরিবিদ্যা শিখেছিলাম এক ওস্তাদের কাছে। তিনি আমাকে তিনটি নীতি শিখিয়েছিলেন—

যার উপকার করবি, তার ঘরে চুরি করবি না;

যে বউয়ের কথা শোনে, তার ঘরে চুরি করবি না;

আর কৃপণের ঘরে চুরি করবি না।

 

আমি তিনবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রতিবারই সেই নীতিগুলো মনে পড়ে গিয়েছিল। শেষবার রাজপ্রাসাদে এসে আল্লাহর রহমতে আপনাকে রক্ষা করলাম। আমি যদি অপরাধীও হই, তবে আজ আমার অন্তর পরিশুদ্ধ।”

 

রাজামশাই গভীরভাবে তাকালেন তার দিকে। ঘুরি মিয়ার চোখে অনুতাপ, বিনয় আর সত্যের ঝলক। রাজা মৃদু হেসে বললেন,

“তুমি রাজ্য রক্ষা করেছো। তুমি শুধু চোর নও, তুমি নীতিবান মানুষ। তোমার এই সততা ও সাহসের জন্য আমি প্রতিশ্রুত পুরস্কার দিচ্ছি।”

 

রাজামশাই তখন ঘোষণা করলেন—

“আজ থেকে ঘুরি মিয়া হবে আমার অর্ধেক রাজ্যের শাসক! আর আমার কন্যা রাজকুমারী আমানাকে তোমার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হবে!”

 

সবাই অবাক হয়ে গেল। চোর যে একদিন রাজকুমারীর স্বামী হবে, তা কে ভেবেছিল?

 

🍌জীবনের নব অধ্যায়

 

বিয়ের দিন রাজপ্রাসাদে আলো ঝলমলে উৎসব। গ্রামের মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এসে দেখল, একসময় যাকে তারা চোর বলত, সে আজ রাজ্যের অভিজাত ব্যক্তি। কিন্তু ঘুরি মিয়া কখনো গর্ব করল না। সে মসজিদে গিয়ে সিজদায় পড়ে বলল,

“হে আল্লাহ, তুমি আমার জীবন বদলে দিয়েছো। আমি চোর ছিলাম, তুমি আমাকে নীতিবান করেছো।”

 

রাজকন্যা আমানা ছিল দয়ালু ও শিক্ষিত। সে ঘুরি মিয়াকে বলল,

“তুমি নীতির পথে ফিরেছো, এখন মানুষের উপকারে লাগো।”

তারপর থেকে ঘুরি মিয়া রাজ্যের গরিব মানুষের জন্য সাহায্যের তহবিল গড়ে তুলল। প্রতিটি অনাথ শিশু ও বিধবার জন্য ভাত, কাপড় ও ওষুধের ব্যবস্থা করল।

 

লোকজন বলত, “এই রাজ্যে এখন নীতিবান রাজা আছেন, যার নাম ঘুরি মিয়া।”

 

💐শেষ দৃশ্য

 

বছর পেরিয়ে যায়, রাজ্যে শান্তি ফিরে আসে। নদীর পাড়ে আবার ছেলেমেয়েদের হাসি, মাঠে কৃষকের গান, আকাশে ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা। ঘুরি মিয়া প্রতিদিন বিকেলে রাজপ্রাসাদের ছাদে বসে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে ভাবত,

“ওস্তাদের তিনটি কথা যদি আমি না মানতাম, হয়তো আজ আমি মৃত্যুদণ্ডে ঝুলতাম।”

 

তার মনে পড়ে যায় দারিদ্র্যের সেই দিনগুলো, আর মনে মনে বলে—

“মানুষের জীবনে যতই কষ্ট আসুক, সঠিক পথ কখনো ত্যাগ করা উচিত নয়। নীতির আলোয়ই মুক্তি।”

 

সেই আলোয় রাজ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর ঘুরি মিয়া চিরকাল মনে রাখল—

চুরি দিয়ে জীবন শুরু হলেও, সততার আলোতেই জীবন সম্পূর্ণ হয়।

 

💐শেষ কলমে,

🪶মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম

🕐তারিখ:১০/১০/২০২৫

Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL Islam.