[✓] মজার গল্প:সূফি সাহেবের শেষ ইচ্ছা
রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
তারিখ:২৯/১০/২০২৫
১. এক নিঃসঙ্গ বিকেল
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গ্রামের পুরোনো মসজিদের পাশ দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছেন সূফি আবদুল মজিদ সাহেব। বয়স পেরিয়েছে সত্তরের কোঠা, কিন্তু মুখে শান্তির ছাপ। মাথায় সাদা টুপি, হাতে লাঠি, পাঞ্জাবির পকেটে ছোট একটা তসবীহ। তিনি ছিলেন একসময় নামকরা জমিদার। এখনো জমি-জিরাত আছে, তবে সময়ের সাথে সবই যেন কিছুটা হারিয়ে গেছে।
বাড়িতে আছেন একমাত্র মেয়ে — সকিনা। বয়স তিরিশের কোঠায়, উচ্চশিক্ষিতা, পরহেজগার এবং বিনয়ী। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর তিনিই বাবার সেবা করে আসছেন।
সূফি সাহেব আজকাল খুব অসুস্থ। ডাক্তারের ভাষায়, “হার্টের অবস্থা ভালো না।” তবুও তিনি শান্ত। প্রতিদিন নামাজ শেষে চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“হে আল্লাহ, আমার এই মেয়ে যেন কষ্ট না পায় আমার পরে।”
২. সম্পদের হিসাব
এক রাতে সকিনা খেতে দিতে দিতে বলল,
— “আব্বা, আপনি আজকাল খুব চিন্তিত দেখাচ্ছেন। কী হয়েছে?”
সূফি সাহেব নিঃশব্দে তসবীহ ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,
— “বাবা, আমি জানি আমার দিন ফুরাচ্ছে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে— আমি যে সম্পদ রেখে যাব, তা কেমন কাজে লাগবে? তুমি একাই তো উত্তরাধিকারী। ভাবছি, জীবদ্দশাতেই বড় অংশ দান করে দিই, মসজিদ-মাদরাসায়।”
সকিনার চোখে পানি।
— “আব্বা, আমি আপনার দান-খয়রাতের বিরোধী না। কিন্তু আপনি সবই যদি দিয়ে দেন, আমি কি বাঁচব কিভাবে?”
সূফি সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
— “আল্লাহই রিযিকদাতা, মা। আমি শুধু ভয় পাই মৃত্যুর আগে ধন আমার জন্য ফিতনা হয়ে না দাঁড়ায়।”
সেই রাতে সকিনা চুপচাপ বসে থাকল বারান্দায়। দূরে গ্রামের মসজিদের দিক থেকে ভেসে আসছিল আজানের ধ্বনি। তার চোখে যেন ভাসছিল হযরত সা’দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর সেই ঘটনার চিত্র —
যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় ছিলেন, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন:
“তুমি তোমার সন্তানদের ধনী রেখে যাও, সেটাই উত্তম, তাদের ভিক্ষুক বানিয়ে ফেলা নয়।”
৩. মাওলানা অনুপম হোসেনের আগমন
পরদিন সকালে গ্রামে এলেন মাওলানা অনুপম হোসেন, পাশের উপজেলার মাদরাসার প্রভাষক। তিনি সূফি সাহেবের পুরোনো ছাত্র ছিলেন। বয়স এখন পঞ্চাশ, কিন্তু আচরণে বিনয়ী ও দার্শনিক ধাঁচের মানুষ।
সালাম বিনিময়ের পর তিনি বললেন,
— “হুজুর, শুনলাম আপনি সম্পদের বড় অংশ দান করার চিন্তা করছেন?”
সূফি সাহেব হেসে বললেন,
— “হ্যাঁ মাওলানা সাহেব, মনে হয় এ দুনিয়ায় আর বেশিদিন নেই। তাই ভাবছি— মসজিদের জন্য দশ বিঘা জমি দান করে দিই।”
মাওলানা অনুপম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
— “হুজুর, আমি সাহাবায়ে কেরামের জীবনের একটা ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাই।”
সূফি সাহেব কৌতূহলী হলেন।
মাওলানা অনুপম বললেন,
“একবার হযরত সা’দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) মক্কায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে জানতে চান — তাঁর অনেক সম্পদ, একমাত্র মেয়ে উত্তরাধিকারী। তিনি কি তার দুই-তৃতীয়াংশ, তারপর অর্ধেক, তারপর এক-তৃতীয়াংশ দান করতে পারেন? নবীজি (সা.) বলেছিলেন — ‘না, এক-তৃতীয়াংশও অনেক। তুমি যদি তোমার সন্তানকে সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাও, সেটাই শ্রেষ্ঠ।’”
তিনি থামলেন।
— “হুজুর, এই হাদীসটা আমাদের শেখায় — সম্পদ দান করতে হবে, কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব ভুলে নয়।”
সূফি সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
— “তুমি ঠিক বলছো, মাওলানা সাহেব। আমি ভয় পাই, মৃত্যুর পর আমার টাকা অহেতুক কাজে নষ্ট হয়ে যাবে।”
মাওলানা অনুপম উত্তর দিলেন,
— “তাই বলছি, আপনি যদি নিয়ত করেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করবেন, তবে স্ত্রী-কন্যার উপর খরচও দান হিসেবে গণ্য হবে। এমনকি নবীজি (সা.) বলেছেন— ‘যে লোকমা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দাও, তাতেও সওয়াব আছে।’”
সূফি সাহেবের চোখে অশ্রু জমল।
তিনি ধীরে বললেন,
— “সত্যিই তো, আমি সকিনার মুখে যে ভাত তুলে দেই, সেটাও ইবাদত হতে পারে।”
৪. সমাজের কানাঘুষা
কিন্তু গ্রামের লোকেরা ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি।
কেউ বলল, “সূফি সাহেব সব দান করে দেবে, মেয়েটা তো পথে বসবে।”
আর কেউ বলল, “ওরা জমি রেখে দান করলে সমাজে নাম করবে, নিজেরা খাবে কী?”
এইসব কথা কানে গেল সকিনারও।
সে কেঁদে বলল,
— “আব্বা, সমাজের কথায় কান দেবেন না। আপনার নিয়ত যদি ভালো হয়, আল্লাহ আপনাকে মর্যাদা দেবেন।”
সূফি সাহেব বললেন,
— “আমার মেয়ে, আমি চাই তুমি আল্লাহর নামে বাঁচো। তবে দান করলেও তোমার অধিকার যেন অক্ষুণ্ণ থাকে, সেটাও চাই।” তিনি আরো বললেন-
আজকাল আমাদের সমাজে অনেকেই ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে ভক্ষণ করে যা আল্লাহ বরদাসত করে না যা জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করার সমতুল্য। আমাদের বান্দার হক আল্লাহর হক দুইটা জিনিস অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। নাহলে পরপারে জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করতে হবে।
৫. এক চিঠি
সেই রাতেই সূফি সাহেব লিখলেন একটি চিঠি, মাওলানা অনুপমের নামে—
“প্রিয় অনুপম,
আমি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীসের আলোকে স্থির করেছি, আমার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ দান করব মসজিদ-মাদরাসার কাজে। বাকিটা থাকবে সকিনার জন্য। যেন সে কখনো মানুষের কাছে হাত না বাড়ায়।
নবী করিম (সা.) বলেছেন— ‘তুমি তোমার সন্তানদের অভাবগ্রস্ত রেখে যেও না।’ এই নির্দেশই আমার অন্তরের শান্তি।”
চিঠি পাঠিয়ে তিনি যেন একপ্রকার হালকা হয়ে গেলেন।
৬. শেষ সকাল
কয়েকদিন পরেই তাঁর শারীরিক অবস্থা অবনতি হলো। সকিনা দিনরাত পাশে থাকে। মাওলানা অনুপম প্রায় প্রতিদিন আসেন দেখতে।
এক সকালে সূফি সাহেব বললেন,
— “মাওলানা সাহেব, আমি যদি মারা যাই, আমার দানপত্র অনুযায়ী সব কার্যক্রম যেন হয়।”
— “ইনশাআল্লাহ, হুজুর,” অনুপম বললেন, “আপনার নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাই আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আপনি হিজরতের মতই মহান একটি কাজ রেখে যাচ্ছেন— মানুষ উপকৃত হবে আপনার দানে।”
সূফি সাহেব শান্তভাবে বললেন,
— “আমার মতো আরেকজন সাহাবি ছিলেন— সা’দ ইবনু খাওলা (রাঃ)। নবীজি (সা.) তাঁর জন্য আফসোস করেছিলেন, কারণ তিনি মক্কায় মারা যান, মদিনায় হিজরতের পর। আমি চাই না আমার জীবনও অসম্পূর্ণ থেকে যাক।”
৭. আলোর পথ
সেদিন বিকেলে সূফি সাহেবের মৃত্যু হলো। তাঁর মুখে তখন ছিল তসবীহের শব্দ— “আল্লাহু আকবার… আল্লাহু আকবার…”
গ্রামের মানুষ তাঁর জানাজায় ভিড় করল। সকিনার চোখ ভেজা, কিন্তু অন্তরে এক শান্তির পরশ। কারণ সে জানে, তার বাবা কোনো কৃপণতা নয়, বরং প্রজ্ঞা রেখে গেছেন ।
“দানও করো, দায়িত্বও পালন করো।”
৮. উত্তরাধিকার
মাওলানা অনুপম সূফি সাহেবের উইল অনুযায়ী জমির এক-তৃতীয়াংশ দান করলেন স্থানীয় মসজিদ ও মাদরাসার নামে। বাকিটা রইল সকিনার নামে।
কিছুদিন পর সকিনা মাদরাসায় গিয়ে মেয়েদের জন্য এক “সুফি আবদুল মজিদ মহিলা শিক্ষা ট্রাস্ট” গড়ে তুলল। উদ্দেশ্য— গ্রামের মেয়েদের কুরআন শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতা শেখানো।
সেদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাওলানা অনুপম বক্তৃতা দিলেন—
“প্রিয় ভাই ও বোনেরা, সূফি সাহেব আমাদের শেখালেন, ইসলাম দানের ধর্ম হলেও দায়িত্বহীনতার ধর্ম নয়। নবীজি (সা.) বলেছিলেন—
‘যে নিজের পরিবারকে অবহেলা করে, সে পূর্ণ মুমিন নয়।’
তাই দান করতে হবে ভারসাম্যের সাথে— নিজের সন্তানকে অভাবগ্রস্ত না রেখে।”
৯. সকিনার উপলব্ধি
রাতের বেলায় সকিনা বাবার পুরোনো তসবীহ হাতে নিয়ে বসে আছে। মনে মনে বলে—
> “আব্বা, আপনি যেমন শিখিয়েছেন— আমিও চাই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে, কিন্তু নিজের দায়িত্ব ভুলে নয়।”
তার চোখে ভেসে ওঠে নবী করিম (সা.)-এর সেই মৃদু হাসি, যখন তিনি সা’দ (রাঃ)-কে বলেছিলেন,
> “তুমি তোমার সন্তানদের ধনী রেখে যাও, সেটাই উত্তম।”
সেই শিক্ষাই আজ সকিনার জীবনের মন্ত্র।
১০. সমাজে পরিবর্তন
কিছু মাস পরে দেখা গেল, সকিনার প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্টে(Toast) গ্রামের অনেক মেয়েরা পড়াশোনা করছে, কেউ সেলাই শেখছে, কেউ কুরআন তেলাওয়াত শিখছে।
গ্রামবাসী অবাক হয়ে বলে,
— “যে সম্পদ সূফি সাহেব রেখে গিয়েছিলেন, তা কত সুন্দরভাবে সমাজে উপকার আনল!”
মাওলানা অনুপম একদিন সকিনাকে বললেন,
— “তুমি তোমার বাবার সওয়াব বাড়িয়ে চলেছো, যেমন নবীজি (সা.) বলেছিলেন—
> ‘যখন মানুষ মারা যায়, তার কর্ম বন্ধ হয় তিনটি ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান, ও সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’
তোমার মাধ্যমে তোমার বাবার সদকায়ে জারিয়া চলতেই থাকবে।”
সকিনার চোখে আবারও জল, কিন্তু এবার আনন্দের।
১১. শেষ বার্তা
গ্রামের মসজিদের মিনার থেকে একদিন নতুন মাইক বেজে উঠল। সেটিও সূফি সাহেবের দান করা টাকায় কেনা।
আজান হলো, “হাইয়া ‘আলাস সালাহ… হাইয়া ‘আলাল ফালাহ…”
মাওলানা অনুপম নীরবে চোখ বন্ধ করলেন।
মনে মনে বললেন,
“হুজুর, আপনি চলে গিয়েও জীবন্ত রয়ে গেছেন — আপনার দান, দায়িত্ববোধ আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে।”
১২. উপসংহার
এই গল্প শুধু সূফি সাহেব ও তাঁর কন্যা সকিনার কাহিনি নয় — এটি এক চিরন্তন ইসলামী শিক্ষার প্রতিফলন।
মানুষ দান করবে, সওয়াব কামনা করবে, কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব ভুলে নয়।
নবী করিম (সা.) যেমন সা’দ (রাঃ)-কে শিক্ষা দিয়েছিলেন—
> “الثلث والثلث كثير — এক-তৃতীয়াংশ অনেক।”
তেমনি আমাদেরও শেখা উচিত, ভারসাম্যের সঙ্গে ব্যয় করা, যাতে দানও হয়, দায়িত্বও পূর্ণ হয়, এবং সমাজও উপকৃত হয়।
💐শেষ কলমে,
মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🍌প্রভাষক হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা মান্দা,নওগাঁ।
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL ISLAM.
—