💐ছোটগল্প: “জাটকা মিয়ার দুঃখ”
🪶রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🌺প্রভাষক হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা মান্দা নওগাঁ ।

রসুলপুর—একটি মাটির ঘ্রাণে ভরা গ্রাম, যেখানে সূর্য ওঠে ধানক্ষেতের ফাঁক দিয়ে আর পাখির কোলাহলে সকাল হয়। গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় একটা পুরোনো তালগাছের পাশে ছোট্ট একটা চা দোকান, যেখানে বসে গ্রামের লোকজন রাজনীতি, ধর্ম, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে তর্ক করে, হাসে, আবার বিষাদে ডুবে যায়।
এই রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিল জাটকা মিয়া।
সে ছোট থেকেই অন্যরকম ছিল—চালাক, চটপটে, কিন্তু মনে হিংসার বিষ পুষে রাখত। কারো একটু উন্নতি দেখলেই চোখের পাতায় আগুন জ্বলে উঠত, মুখে হাসি, মনে বিদ্বেষ। তার এই গুণ সবাই জানত, তবে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলত না। সে মিশুক ছিল, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।
তার একসময়কার বন্ধু ছিল সলিমুদ্দিন।

গরিব ঘরের ছেলে, বাবার সামান্য জমি আর মায়ের সেলাই করা কাপড় বিক্রি করে চলত সংসার। কিন্তু ছেলেটা ছিল মেধাবী, পরিশ্রমী আর ভদ্র। গ্রামের মক্তব থেকে শুরু করে হাইস্কুল পর্যন্ত প্রথম স্থানেই থেকেছে। সে শুধু দুনিয়ার বিদ্যাই নয়, দ্বীনিক জ্ঞানেও ছিল আগ্রহী—নিয়মিত মসজিদে যেত, হাদিস পড়ত, কুরআন মুখস্থ করত।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় সে বোর্ড স্কলারশিপ পেল। এরপর একে একে ঢাকা, বড় বিভিন্ন সংস্থা থেকে, এমনকি শিল্পকলা একাডেমি থেকেও সম্মাননা পেল—তার লেখা রচনা জেলার সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ২য় হয়।
গ্রাম জুড়ে তখন সে এক আলোচিত নাম—”সলিম আমাদের গ্রামের গর্ব!”
এত কিছু সহ্য হয়নি জাটকা মিয়ার।
তার হিংসার আগুনে যেন বাতাস পড়ল।
সে ভাবল—”এই সলিম একদিন আমাদের মাথার উপর চড়ে বসবে! না, এটা হতে দেওয়া যাবে না।”
তাই সে শুরু করল এক অশুভ পরিকল্পনা।

🔻 চক্রান্তের জাল
একদিন সন্ধ্যায় খোকা মিয়া আর বিপুল মিয়াকে নিয়ে সে চা দোকানে বসে বলে—
“দেইখো, এই সলিমটারে একটু থামাইতে না পারলে, আমরা কেউ কিছু হইতে পারমু না। তোরা একটা বুদ্ধি আন।”
তারা মিলে ঠিক করল, একটা মেয়েকে দিয়ে সলিমকে প্রেমের ফাঁদে ফেলবে। তাকে ধর্ম থেকে, পড়াশোনা থেকে, নিজের লক্ষ্যের পথ থেকে সরিয়ে ফেলবে।
এক মেয়েকে ঠিক করা হলো, যে আধুনিক পোশাকে, সোশ্যাল মিডিয়াতে সক্রিয়—সে হঠাৎ সলিমের সাথে ‘ইসলাম জানার আগ্রহ’ দেখিয়ে যোগাযোগ করে।
সলিম সরলমনা, সে ভাবল কেউ সত্যিই দ্বীন জানতে চাইছে। সে কুরআনের কথা বলল, হাদিস পাঠালো। কিন্তু ধীরে ধীরে কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নিল।
যদিও সে প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি, পরে ধীরে ধীরে বিষয়টি তার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে।
এই ফাঁদের পাশাপাশি গ্রামের কিছু ছেলে তাকে নিয়ে কটাক্ষ করতে লাগল—কেউ বলল, “বড় মাওলানা হইছেন দেখি!”, কেউবা বলল, “চলছে অভিনয়!”
এমনকি কেউ কেউ বাজারে বলে বেড়াল—”সলিম না কি একটা নতুন ফেরকা শুরু করছে, শহর থেকে টাকা আসে!”
সবাই জানত, এসব মিথ্যে। কিন্তু জাটকা মিয়ার চালবাজি এমনই ছিল যে, গ্রামের সহজ সরল মানুষও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

🔻 সফলতা ও ঘুরে দাঁড়ানো

আল্লাহর সাহায্য আসে তার জন্য, যিনি সত্যে অটল থাকে।
সলিম এসব ষড়যন্ত্রের মাঝেও নিজেকে ভেঙে পড়তে দেয়নি।
সে পড়ালেখা চালিয়ে গেল—একসময় মাস্টার্স শেষ করল, ঢাকা আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি  সাহিত্যে প্রথম শ্রেণি পেল। শহরে চাকরি পেল একটা ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে।
সেখানে থেকেই সে গরিব ছাত্রদের পড়াতে লাগল, কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা করল, মাদরাসাগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করল। তার উদ্যোগে গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন ঢাকায় পড়তে আসে।
এই সময় সে গ্রামের দিকে ফিরে তাকাল।
গ্রামের কিছু ছেলেকে সামান্য পরীক্ষায় পাশ করলেই সংবর্ধনা দেওয়া হয়—মাইক, ফুল, মিষ্টি…
কিন্তু যে ছেলে এত অর্জন করল, তাকেই কেউ একটা ফুল পর্যন্ত দেয়নি!
এ দৃশ্য তাকে কষ্ট দিল না, বরং তাকে ভাবিয়ে তুলল—“এই সমাজ শুধু গা বাঁচিয়ে চলে। কে কিভাবে জয় করল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—কে কীভাবে নিজের হিংসা ঢাকলো।”
🔻 ইকবাল হোসেনের আগমন
ঠিক তখনই শহর থেকে আসেন ইকবাল হোসেন নামে একজন সত্যিকার আলেমে দ্বীন। তিনি গ্রামে এসে মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলেন—
> “তোমরা কি জানো হিংসা কী? হিংসা হলো আগুন, যা অন্যকে নয়, প্রথমে হিংসুককে পোড়ায়।
একজন যুবক যখন দ্বীন ও শিক্ষার পথে এগিয়ে যায়, তখন তাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত।
আর তোমরা তাকে ঠেকাতে চেষ্টা করো—এটা কি ইসলামের শিক্ষা?”
তার জ্বালাময়ী খুতবায় গ্রামের অনেকের মুখ নিচু হয়ে যায়।
জাটকা মিয়া তখন দোকানের এক কোনায় বসে কাঁপছিল। সে বুঝল—তার দুঃখ, তার অস্থিরতা, তার রাতের ঘুম না হওয়া—সবই হিংসার আগুনের ফল।
একদিন সে সলিমের কাছে চুপচাপ এসে বলে,
“তুই ভালো থাক, ভাই। আমি তোকে অনেক কষ্ট দিছি… আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ কইরা দিস।”
সলিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল—
“আমি তোদের কখনো দুশমন ভাবিনি। আমি শুধু আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। তাই আজও টিকে আছি।”

🔻 শেষ কথা
জাটকা মিয়ার চোখে পানি এসেছিল।
সে জানত, সে হেরে গেছে। তবে এই হারা তার জীবনের এক শিক্ষা।
✓শিক্ষণীয় বার্তা:
🔹 হিংসা কারো উন্নতি থামাতে পারে না, বরং হিংসুককে ভেতর থেকে খায়।
🔹 যারা সত্য ও ইলমের পথে এগিয়ে চলে, আল্লাহ তাদের সহায় হন।
🔹 ইসলামে সফল ব্যক্তিকে অপমান নয়, সম্মান দেওয়া উচিত।
📖 কুরআন বলে:
“وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ”
“তোমরা দুর্বল হয়ো না, দুঃখ করো না; তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমানদার হও.” — (সূরা আলে ইমরান: ১৩৯)

🖊️রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🦜আরবি প্রভাষক বলদীআটা ফাজিল মাদ্রাসা ধনবাড়ী টাঙ্গাইল জেলা।
Gmail: islamiclecturer7@gmail.com