🪶 মজার গল্প : রম্য রচনা বাছা,জামাই ,ডাউল কান্ড ✍️রচনায়:মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম তারিখ:১০/১০/২০২৩

Reporter Name / ১৮ বার পড়া হয়েছে

আপডেট: শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫

শেয়ার করুন

🪶 মজার গল্প : রম্য রচনা বাছা,জামাই ,ডাউল কান্ড
✍️রচনায়:মোঃ ফরিদুল ইসলাম
তারিখ:১০/১০/২০২৩

বাংলার এক নিঝুম গ্রাম—সবুজ ধানের ক্ষেত, কাশবনে দোল খাওয়া হাওয়া, আর মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সরু খাল। ভোরবেলা যখন সূর্যের আলো পুকুরের জলে পড়ে, তখন মনে হয় যেন সোনার পাতার মতো কিছু ঝিলমিল করছে জলের ওপর। ওই গ্রামেরই নাম ছিল দুলালপুর। গ্রামের উত্তরে ছিল এক বিশাল জমিদারবাড়ি—লাল দোতলা দালান, চৌবাচ্চা পুকুর, গাছগাছালি আর চাকর-বাকরের আনাগোনা।

এই দালানের মালিক ছিলেন জমিদার শুটকা খাঁ। নাম শুনে কেউ কেউ হাসতো—“এই আবার জমিদারের নাম!”—কিন্তু গ্রামের লোকেরা জানত, শুটকা খাঁ নামটা যেমন অদ্ভুত, লোকটিও তেমনি বিচিত্র।

তার ধনসম্পদের অভাব ছিল না। বাড়িতে ছিল এক গোয়াল ভর্তি মহিষ, খামারে হাঁস-মুরগি, আর ধানভরা গোলাঘর। সকালে উঠেই চাকররা পুকুরে হাঁস ছাড়ে, কেউ আবার গাভী দোহে, কেউবা খাঁ সাহেবের পান সাজায়। তার স্ত্রী কলিমুন নেসা বেগম, একেবারে গৃহিণীর আদলে কড়া হাতে সংসার চালাতেন। আর তাদের একমাত্র মেয়ে, সাকিনা বেগম, রূপে-গুণে গ্রামের সবার আলোচনার কেন্দ্র।

সাকিনা ছিল চুপচাপ, লাজুক মেয়ে—মায়ের মতো কড়া নয়, তবে কোমলতায় ভরপুর। শুটকা খাঁর ঘরে বরের প্রস্তাব আসত অহরহ, কিন্তু খাঁ সাহেব বলতেন, “এখনও মেয়েটা ছোট, একটু বড় হোক, দেখি কোনো সওদাগর ঘরের পাত্র পাই কিনা।”

🍌বাছার আগমন

একদিন গ্রামের হাটে খবর রটে গেল—“শুটকা খাঁর বাড়িতে নাকি নতুন চাকর লাগবে।” খবরটা পেয়ে এক বুদ্ধিমান বাটপার ছোকরা, নাম তার আসলে জোকার বাটপার, ভাবল, “জমিদারবাড়িতে ঢুকতে পারলেই জীবনে সুখ। খাওয়া-দাওয়া ফ্রি, আবার টাকা পয়সাও মেলে।”

ছেলেটি চটজলদি গা পরিষ্কার করে, পাঞ্জাবি পরে, হাতে একটা পুরনো লাঠি নিয়ে হাজির হলো শুটকা খাঁর বাড়ির ফটকে।

ফটকের পাশে এক দারোয়ান গামছা কাঁধে বসে তামাক টানছিল। ছেলেটি বিনয়ে বলল,
—“চাচা, খাঁ সাহেব আছেন? শুনলাম, কাজের লোক নিচ্ছেন।”

দারোয়ান চোখ কুঁচকে ছেলেটির চেহারা দেখে বলল,
—“তুমি কে রে বাবা?”

ছেলেটি হাসল,
—“আমি বাছা। কাজ জানি অনেক কিছু।”

দারোয়ান ভেতরে খবর দিল। কিছুক্ষণ পর শুটকা খাঁ বেরিয়ে এলেন, মাথায় মখমলের টুপি, গায়ে মোটা সুতির চাদর।

—“তোর নাম কী বললি?”

—“বাছা, হুজুর।”

—“হুঁম… ভালো নাম। বাজার-সদাই করতে পারিস?”

—“জি, পারি। দরদামও করতে জানি।”
খাঁ সাহেব বললেন, “তাহলে আজ থেকেই শুরু কর। কাজ ঠিকমতো করবি, বেতন পাবি মাস শেষে।”
এভাবেই রহিম বাটপার নতুন পরিচয়ে ‘বাছা’ হয়ে গেল শুটকা খাঁর বাড়ির চাকর।

🖋️গ্রামের সকাল ও জমিদারবাড়ির আবহ

দুলালপুর গ্রামে সকাল মানেই আলাদা রকম আনন্দ। মসজিদের আজান, খালে নৌকা বাওয়া, গরু-ছাগলের ডাক, আর হাঁসেদের পুকুরে ছপছপ আওয়াজ—সব মিলিয়ে এক সোনালি ছোঁয়া।

শুটকা খাঁর বাড়ির পেছনের বড় পুকুরটা যেন এক রত্নভান্ডার। পাড়ে ঝাউগাছ, নারকেল, তালগাছের ছায়া। বিকেলে সাকিনা সেখানে হাঁটতে আসত। কখনও কখনও কলিমুন নেসা পুকুরঘাটে বসে হাঁস গুনতেন—“এই যে পঁয়ত্রিশটা ছাড়লাম, ফেরে কত আছে দেখি।”

বাছা সারাদিন ব্যস্ত থাকত। সকালে বাজারে যেত, দুপুরে মহিষ খাওয়াত, বিকেলে বেগম সাহেবার খেয়ালখুশি মেটাত। তার ভেতরে কিন্তু শুরু থেকেই ছিল এক ‘চালাকি’। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল শুটকা খাঁর মেয়ে সাকিনার কাছে ঘেঁষা।

💐তিন নামে তিন চেহারা😏

একদিন কলিমুন নেসা রান্নাঘরে ডেকে বললেন,
—“এই বাবা, তোর নামটা কী যেন বললি?”
ছেলেটি এক দুষ্টু হাসি হেসে বলল,
—“আমার নাম জামাই।”
কলিমুন নেসা একটু থমকালেন, “আরে, কী আজব নাম রে বাবা! জামাই নামও কেউ রাখে?”
ছেলেটি হেসে বলল,
—“বাপ মা অনেক আশা করে এই নাম রাখছেন।”
বেগম সাহেবা মনে মনে ভাবলেন, নামটা মজার, তবে ছেলে কাজে ও ভালো।

পরে দুপুরে সাকিনা রান্নাঘরে ভাত বসাচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করল,
—“তোমার নাম কী?”

ছেলেটি এবার বলল,
—“আমার নাম ডাউল।”
সাকিনা অবাক হয়ে হাসল, “ডাউল? ওটা তো খাবার, মানুষ না!”
সে নির্লজ্জভাবে জবাব দিল, “মানুষও খাওয়া যায়,আপা।”
সাকিনা চমকে তাকাল, তারপর চুপ করে গেল।

অন্যদিকে, শুটকা খাঁ যখন একদিন বাজারে যাবার আগে নাম জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি বলল,
—“আমার নাম বাছা।”

তিনজনের কাছে তিন নাম, আর তিনজনই জানে না একে অপরের কথাটি। এইভাবেই রহিম বাটপারের চালাকি চলতে লাগল।

👉অসভ্যতার শুরু

এক বিকেলে, সাকিনা পুকুরঘাটে বসে ডাউল (মানে রহিম) কে বলল,
—“এই, একটু গামছাটা এনে দাও তো।”
এভাবেই চলতেছিল বাটপার ছেলেটিং কর্মকান্ড।
ছেলেটি গামছা দিতে গিয়ে ইচ্ছে করেই তার হাতে হাত ছোঁয়াল। সাকিনা সরে গিয়ে বিরক্তভাবে বলল,
—“কি করছো এসব!”
সেদিনের পরের ঘটনা একদিন সাকিনা ডাউল রান্না করতে ছিল এমন সময় ছেলেটি ছকিনার গায়ে হাত দিল এবং অসভ্যতা করতে চাইল।
সাকিনা বলল কি করছে এসব আমি কিন্তু মাকে ডাকবো।
কিন্তু ছেলেটি হাসতে হাসতে বলল,
—“ডাউল না নাড়লে ভালো হয় না আপা।”
সাকিনা রেগে উঠে ঘরে গিয়ে মাকে বলল,
—“আম্মা, দেখো না ডাউল কেমন যেন করে!”

কলিমুন নেসা তখন হাঁসের ডিম গুনছিলেন। তিনি ভাবলেন, মেয়ে হয়তো রান্নার ডাউল নিয়ে কথা বলছে। তাই বললেন,
—“আরও ভালো করে নাড়াচাড়া কর মা, তাহলে ভালো হবে।”

সাকিনা অবাক হয়ে বলল,
—“আম্মা, আমি বলছি লোকটার কথা!”
কিন্তু ততক্ষণে লোকটা চুপিচুপি বেরিয়ে গেছে।

🥴চিৎকার আর বিভ্রান্তি

পরদিন দুপুরে আবার একই ঘটনা ঘটল। এবার সাকিনা উচ্চস্বরে চিৎকার দিল,
—“বাঁচাও, ডাউল আমারে ছোঁয়েছে!” আমার গায়ে ধরেছে।

ঘরের ভেতর থেকে কলিমুন নেসা চমকে উঠলেন। তিনি ভেবেছেন, রান্নার ডাউল পুড়ে গেছে। চিৎকার করে বললেন,
—“জামাই, ধরো!”

এদিকে রহিম তো বুঝতে পারল ব্যাপারটা ফাঁস হয়েছে। সে দৌড় দিল দরজার দিকে।

শুটকা খাঁ তখন উঠোনে বসে হুক্কা টানছিলেন। শব্দ শুনে ছুটে এসে বললেন,
—“বাছা, ধরো ওকে!”

এইবার চাকর-বাকররা হতবাক! কার নাম বাছা, কার নাম জামাই, কার নাম ডাউল—সব মিশে গেল এক গোলকধাঁধায়।

কেউ ভাবল, “জামাই কে ধরব?” কেউ আবার নিজের কোমর চেপে দাঁড়িয়ে রইল, কারণ তারা বুঝেছিল “বাছা ধরো” মানে বাছা অন্ডকোষের মতো কিছু ধরতে হবে!

এদিকে রহিম বাটপার তখন দরজা পেরিয়ে ছুটছে। গ্রামের কিছু ছোট ছেলেপেলে উঠোনে হাসিতে ফেটে পড়ল। এক জন চিৎকার দিল,
—“দ্যাখো দ্যাখো, বাছা, জামাই ,ডাউল পালাচ্ছে!”

💐গ্রামজীবনের হাস্যরস

জোকার দৌড়ে পুকুরপাড়ে এসে থামল। হাঁপাতে হাঁপাতে খালের ধারে বসে ভাবল, “ওরা তো এখনো বুঝতেই পারেনি আমি কে!”

এদিকে গ্রামের লোকজন সব খবর পেয়ে গেল। কেউ বলল, “ওই যে খাঁ সাহেবের বাড়ির চাকর পালাচ্ছে, নাকি ওর তিনটা নাম!”

আর কেউ হেসে বলল, “বাছা ,নাকি জামাই, না ডাউল—সব মিলে পাকা চালবাজ।”

বিকেলে পুকুরপাড়ে হাট বসে গেল। গ্রামের মহিলারা হাঁস বিক্রি করছে, কেউ দুধ আনছে, কেউ সবজি। সবখানে এখন হাসির রোল—“শুনছো, শুটকা খাঁর বাছা, নাকি জামাই হইয়া ডাউল খাইতে পালাইছে!”

খাঁ সাহেবের চাকর-বাকররা লজ্জায় মুখ ঢাকল, আর সাকিনা তখনও ঘরে কাঁদছে। কলিমুন নেসা নিজের ভুল বুঝে হায়-হায় করতে লাগলেন,
—“হায় আল্লাহ, আমি যে ডাউল ঘোটার কথা বললাম, লোকটা তো মেয়ের ইজ্জত নিতে চাইছিল!”

💐শেষ পরিণতি

সন্ধ্যায় শুটকা খাঁ গ্রামের মাতব্বর ডেকে মিটিং বসালেন। সবার সামনে ঘোষণা করলেন,
—“আজ থেকে যে কেউ খাঁ বাড়িতে কাজ নেবে, আগে নাম লিখিত চুক্তি করবে। নাম বদলানো চলবে না।”

গ্রামের লোকেরা হাততালি দিল। কেউ কেউ বলল, “এখন থেকে আর কেউ তিন নামের লোক রাখবে না!”

রহিম বাটপার অবশ্য পালিয়ে গিয়ে পাশের গ্রামে নতুন নাটক শুরু করল। শোনা যায়, সেখানেও সে একদিন ধরা পড়েছিল—তবে এবার নাম রেখেছিল “ময়না মিয়া”।

গ্রামের বুড়োরা এখনো আড্ডায় বসে গল্পটা বলে হাসে—

“এই যে বাছা, জামাই, ডাউল—সব এক শরীরে তিন রূপ। এমন চালবাজি আগে কেউ দেখেনি। তবে ওর জন্যই খাঁ বাড়ির লোক নাম শুনে এখন দশবার ভাবে।”

🐸গ্রামের সৌন্দর্য ও স্মৃতি

আজও দুলালপুরের পুকুরপাড়ে বসলে সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। জলজ ফুল ভাসে, হাঁসেরা ডাকে, বাতাসে কাশফুল দোলে। সন্ধ্যার আকাশে লাল সূর্য ঢলে পড়ে যখন, তখন মনে হয় যেন শুটকা খাঁর সেই পুরনো দালানও হেসে ওঠে—

“বাছা কোথায় রে? জামাই কই? ডাউল ঘোটিস না?”
হাসির রোল ওঠে বাতাসে, আর দুলালপুরের মানুষ বুঝে যায়—
গল্পটি শুধু মজা নয়, শিক্ষা দেয় একটা কথাই—
চালাকি যতই করো, একদিন সত্য বের হয়েই পড়ে।

আপনার মতামত লিখুন :