মজার গল্প : বাঁশ খানের ন্যায়ের বাঁশ
রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
১. গ্রামের সকাল
বাংলার গ্রাম যেন প্রকৃতির এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। ভোর হতেই কাকের ডাক, পাখির কিচিরমিচির, মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙে গ্রামীণ মানুষের। ঘন সবুজ গাছপালা, ঝোপঝাড়, বাঁশবন, কাশবন আর সর্পিল খাল-বিলের মধ্যেই গড়ে ওঠে গ্রামের সৌন্দর্য।
সেই গ্রামেই বাস ঝটকু চৌধুরীর। তিনি ছিলেন গ্রামের মাতবর। প্রায় ৪২ বছর ধরে তিনি এই মাতব্বরি ধরে রেখেছেন। গ্রামের মানুষ অনেকটা অভ্যাসবশতই তার সামনে নতজানু হয়ে থাকত।
কিন্তু এই ঝটকু চৌধুরীর আসল রূপ ছিল অন্য রকম। তিনি ছিলেন কুটিল স্বভাবের, গরিবদের হেয় করার অভ্যাস তার রক্তে মিশে ছিল। সামান্য বেতনে লোকজনকে কাজে লাগানো, তাদের দিয়ে দিনরাত খাটানো, আর সামান্য ভুল করলে গালিগালাজ করা—এসব তার কাছে সাধারণ ব্যাপার। এই লোকটির দুর্নীতি ও চুরি করার অভ্যাস ছিল।
গ্রামের কৃষকেরা অনেকেই তার কাছে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। কারণ তিনি ছিলেন প্রভাবশালী, জমির মালিকও প্রচুর। তার ইশারাতেই গ্রাম পাড়ার অনেক সিদ্ধান্ত হতো।
২. বাঁশ খানের শৈশব
এই গ্রামেরই এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম বাঁশ খানের। তার বাবা সারাদিন ক্ষেত খামারে খেটে কোনো মতে সংসার চালাতেন। ছোটবেলা থেকেই বাঁশ খান বুঝতে শিখেছিল—এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
বাঁশ খানের নামকরণের পেছনেও একটা মজার ঘটনা ছিল। ছোটবেলায় সে যখন পুকুরপাড়ে খেলা করত, তখন তার হাতে সবসময় একটা না একটা বাঁশ থাকত। কখনো সেটা দিয়ে মাছ তাড়াতো, কখনো সেটা দিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকত। গ্রামের ছেলেরা মজা করে তার নাম দিল “বাঁশ খান”। নামটা এমনভাবে ছড়িয়ে গেল যে সবাই সেই নামেই চিনত।
কিন্তু বড় হতে হতে বাঁশ খান অন্যরকম স্বভাবের মানুষ হয়ে উঠল। সে ছিল পরিশ্রমী, সত্যবাদী আর দুঃসাহসী। অন্যায়ের সামনে মাথা নোয়ানো তার স্বভাব ছিল না।
৩. ঝটকু চৌধুরীর গোলামি
কৈশোরে পড়াশোনার সুযোগ না পেলেও বাঁশ খান কাজ শিখে নিয়েছিল। অনেক দিন ঝটকু চৌধুরীর বাড়িতে অল্প টাকায় কাজ করেছে। ঝটকু চৌধুরী তাকে দিয়ে দিনরাত খাটাতেন—কখনো জমিতে, কখনো পশুর খামারে, আবার কখনো ব্যক্তিগত কাজে।
তবে বাঁশ খানের মনে সবসময় একটা স্বপ্ন ছিল—একদিন সে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। অন্যায় শাসন ভেঙে নতুন করে জীবন গড়ে তুলবে। কিন্তু ঝটকু চৌধুরী শয়তানি আর চক্রান্তের কারণে তা সফল হতে ছিল না।
৪. নতুন কাজের সুযোগ
একদিন গ্রামে খবর এলো—দূরের এক প্রভাবশালী জমিদারের বাড়িতে কাজের সুযোগ হয়েছে। সেখানে সরকারি নিয়মের মতো ব্যবস্থা থাকবে। মাসের প্রথম দিন যোগদান করলে চাকরি পাকা হবে। বেতনও ভালো।
এই খবর শুনে বাঁশ খান চুপচাপ গিয়ে যোগাযোগ করল। তার সততা আর পরিশ্রম দেখে জমিদারের বাড়ির ম্যানেজার খুশি হয়ে তাকে কাজের অফার দিল। বাঁশ খান খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। ভেবেছিল—এবার হয়তো জীবনের দুঃখ-দুর্দশা কেটে যাবে।
কিন্তু এ খবর যখন ঝটকু চৌধুরীর কানে গেল, তখনই তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন।
৫. ঝটকুর ষড়যন্ত্র
ঝটকু চৌধুরী ভাবলেন—
“এই ছেলে যদি বেরিয়ে যায়, তবে তো আমার গোলামি ভেঙে যাবে। এতদিন সামান্য টাকায় ওকে দিয়ে কাজ করিয়েছি, এখন সে যদি বড়লোকের বাড়িতে গিয়ে চাকরি করে, তাহলে আর ফিরে আসবে না।”
তাই তিনি বাঁশ খানকে ডেকে অপদস্ত করতে লাগলেন।
“শোন বাঁশ, তুই কাকে জিজ্ঞেস করে বাইরে কাজ নিতে গেছিস? আমাদের কাছে মাফ চা! নইলে তোকে এলাকায় থাকতে দেব না।”
বাঁশ খান সোজা কথা বলল—
“আমি তো জানি না কতটুকু মাপ নিতে হবে। যদি বলেন তবে বাঁশের মাপ, আমি ততটাই নেব। প্রয়োজন মত পাছায় ভরে দেব।কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াব না।”
তার এই সাহসী উত্তর ঝটকু চৌধুরীকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলল।
৬. গ্রামের বৈঠক
এরপর বাঁশ খান গ্রামের গরিব ছেলেপুলে আর মুরুব্বিদের একত্র করল। তারা সবাই বাঁশবনের পাশে খোলা মাঠে বৈঠক বসাল। সন্ধ্যার সময়, যখন আকাশে লাল আভা, তখন সেই বৈঠকের দৃশ্য যেন এক আলাদা আবহ তৈরি করল।
কেউ বলল—
“ঝটকু সাহেবের অন্যায় তো অনেক দিন ধরে চলছে। কারও জমি দখল করেছে, কারও ক্ষেত নষ্ট করেছে, আবার কারও পরিশ্রমের টাকা মেরে দিয়েছে। কিন্তু আমরা মুখ খুলিনি।”
আরেকজন বলল—
“ঠিকই বলেছ। কিন্তু এবার বাঁশ খানের সাহসী কথায় আমাদের বুকের ভিতর আগুন জ্বলে উঠেছে। এখনই সময় অন্যায়ের জবাব দেওয়ার।” এবার ঠিকই আমরা বাঁশ খানের নেতৃত্বে ঝটকো চৌধুরী পাছার মধ্য বাস ভরে দেবো।
সবার মুখে এক সুর—
“ঝটকুর ৪২ বছরের চক্রান্ত এবার শেষ করতে হবে।”
৭. চাঁদের আলোয় প্রতিজ্ঞা
সেই রাতে ছিল পূর্ণিমা। আকাশ ভরা আলো, পুকুরের জলে রুপালি ঝিকিমিকি, চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গ্রামের তরুণেরা চাঁদের আলোয় শপথ করল—
“আমরা বাঁশ খানের পাশে আছি। অন্যায়ের বাঁশ এবার অন্যায়ের ঘাড়েই যাবে।”
৮. চূড়ান্ত মোকাবিলা
পরদিন সকালে বাঁশ খান তার সাথীদের নিয়ে ঝটকু চৌধুরীর বাড়ির সামনে হাজির হলো। সবাই একসাথে ঘোষণা দিল—
“আজ থেকে গ্রামে অন্যায় মাতব্বরি চলবে না। বাঁশ খান আমাদের ন্যায়ের কণ্ঠস্বর। ঝটকুর ৪২ বছরের অত্যাচারের অবসান আজই ঘটবে।”
ঝটকু চৌধুরী প্রথমে রাগ দেখালেও, যখন দেখল গ্রামের সব মানুষ বাঁশ খানের পাশে, তখন তার মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি বুঝলেন—এখন আর তার ক্ষমতা নেই।
৯. নতুন সূর্যোদয়
সেদিন থেকেই গ্রামের আকাশে শান্তির হাওয়া বইতে শুরু করল। মাঠে কৃষকেরা হাসিমুখে কাজ করল, নারীরা নদীর ঘাটে কলস ভরে গান গাইল, আর শিশুরা খেলায় মেতে উঠল।
বাঁশ খান হয়ে উঠল গ্রামের মানুষের নায়ক। তার নাম উচ্চারণ করলে সবাই গর্ব অনুভব করত।
উপসংহার
গ্রামের প্রকৃতি যেমন সরল ও সুন্দর, তেমনি মানুষের হৃদয়ও সৎ হলে অন্যায়কে হার মানাতে পারে। বাঁশ খানের দৃঢ়তা আর সততা প্রমাণ করল—
“সত্যের জয় হবেই, মিথ্যা ও অন্যায় টিকবে না।”
🖋️শেষ কলমে, মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
তারিখ:০২/১০/২০২৫
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL Islam