🖋️ গল্প: “আলেয়ার আফসোস আর সলিম উল্লাহর বোধোদয়”। রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম 🌺

Reporter Name / ১৫ বার পড়া হয়েছে

আপডেট: মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৫

শেয়ার করুন

🖋️ গল্প: “আলেয়ার আফসোস আর সলিম উল্লাহর বোধোদয়”।

বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার সলিম উল্লাহ ও নাটোরের কাসিকাটা গ্রামে আলেয়া নামের এক গরিব ঘরের মেয়ে বাস করত। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই কষ্ট দেখেই বড় হয়েছে সে। একদিন তার বিয়ে হয় নাটোর জেলার কাসিকাটা গ্রামে ।সলিম উল্লাহ নামে এক পরিশ্রমী যুবকের সঙ্গে। সলিম উল্লাহ ছিলেন মসজিদের মুয়াজ্জিন, পাশাপাশি সামান্য জমিতে চাষাবাদ করতেন। মানুষ শান্ত, পরহেজগার, কিন্তু দুনিয়ার চিন্তা তার মনে গভীর ছায়া ফেলেছিল। তার মাঝেমধ্যেই সর্দি-কাশিতে ভোগতে হতো। এই সর্দি কাশির জন্যই সে অনেক কাসের বড়ি খেয়েছে। আজ সে সর্দি কাশি থেকেই মুক্ত হলেও পার্শ্ব প্রতিক্রিতা রয়ে গেছে। গ্রামের কাদাবালি রাস্তা পেরিয়ে যখন শহরের হাইওয়ে রাস্তায় এসে যায় তখন দেখতে পায় নতুন জীবনের সন্ধান। সে দেখে চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্র খাঁখাঁ রোদে যেন মাঠঘাট ফেটে চৌচির। খরাইনা জমিতে হাল চাষ করা যায় না তাই জমি থেকে সোহাগ করে আদরের দুলালের মত পরিপাটি করতে হয়। এই দৃশ্য সলিমুদ্দিন বহুদিন আগে থেকেই দেখেছিল। জীবনের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে সে ফসল আবাদ করেছিল তার জমিতে। ফসলের আবার শেষ হতেই তিনি বিয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন ।

বিয়ের পর বছর ঘুরতেই আলেয়ার কোল জুড়ে আসে এক পুত্রসন্তান—রাশেদ। সলিম উল্লাহর চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক, কিন্তু আলেয়া কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সে ভাবে—“আমাদের ঘরে অভাব, মাঠে ফসল যেমন আসে না, তেমনি রোজগারও অল্প। যদি আরেক সন্তান আসে, কেমন করে তাদের মানুষ করব?”

একদিন সন্ধ্যায়, মসজিদের নামাজ শেষে সলিম উল্লাহ ঘরে ফিরে দেখে আলেয়া চিন্তায় ডুবে আছে। কেরোসিনের বাতির আলোয় সে বলল,

—“হুজুর, আমি শুনেছি জন্মনিয়ন্ত্রণ করলে দারিদ্র্য কিছুটা কমে। আমার ভাবি বলেছে, এখন অনেকেই পিল খায়, ইনজেকশন দেয়। আমরা কি তেমন কিছু করতে পারি?”

সলিম উল্লাহ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,

—“আলেয়া, তুমি কি জানো, রিজিকের মালিক মানুষ নয়—আল্লাহ তাআলা। তিনি কুরআনে বলেছেন:

> وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا

অর্থাৎ, ‘পৃথিবীতে চলমান কোনো প্রাণী নেই, যার রিজিক আল্লাহর ওপর নির্ভর নয়।’ (সূরা হূদ: ৬)”

আলেয়া নিরুত্তর। বাইরে তখন রাত নেমেছে। দূরে শিয়ালের ডাক শোনা যায়—‘হুঁয়া… হুঁয়া…’। ঘরের পাশে এক কুকুর হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠল। সলিম উল্লাহ হেসে বলল,

—“দেখো আলেয়া, ওই শিয়াল-কুকুরেরও রিজিক আল্লাহ দেন। এদের কেউ জমি আবাদ করে না, বাজারে যায় না, কিন্তু আল্লাহর বানানো ব্যবস্থায় ওরাও খেয়ে বেঁচে থাকে। তাহলে আমরা মানুষ—আশরাফুল মাখলুকাত—আমাদের কি আল্লাহ বঞ্চিত করবেন?”

আলেয়ার চোখ ভিজে যায়। কিন্তু বুকের গভীরে ভয় রয়ে যায়—“যদি দুধের বাচ্চাটা বড় হতে না পারে? যদি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি?”

কিছুদিন পর আলেয়া অসুস্থ হয়ে পড়ে। গাবতলী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার বলেন, “আপনার শরীর এখন খুব দুর্বল। অন্তত দুই বছর গর্ভধারণ না করাই ভালো।”

সলিম উল্লাহ বাড়ি ফিরে গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। রাতে তিনি মসজিদের হুজুরের কাছে যান—মাওলানা করিমুদ্দিন সাহেবের কাছে। তিনি আলেম, কুরআন-হাদীসের পণ্ডিত।

সলিম উল্লাহ তার প্রশ্ন রাখে:

—“হুজুর, আমার স্ত্রী খুব দুর্বল। ডাক্তার বলছেন, আপাতত সন্তান না নেওয়াই ভালো। এখন কি আমরা সাময়িকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারি?”

মাওলানা সাহেব ধীরে ধীরে বলেন,

—“দেখ সলিম, শরীয়তে জন্মনিয়ন্ত্রণ (ضَبْطُ التَّرْلِيْدِ) তিন অবস্থায় অনুমোদিত, যদি নেক নিয়তে করা হয়। যেমন—

✓ স্ত্রীর শারীরিক দুর্বলতা থাকলে,

✓অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে,

✓দুগ্ধপোষ্য শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে।

এ ছাড়া, অভাব বা দারিদ্র্যের ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ হারাম। কুরআনে আল্লাহ বলেন:

> لا تَقْتُلُوْا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ

‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না।’ (সূরা আল-ইসরা: ৩১)

আর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

> إِنَّ مَا قُدَّرَ فِي الرَّحْمِ سَيَكُوْنُ

‘যা গর্ভে নির্ধারিত হয়েছে, তাই ঘটবে।’ (সহীহ মুসলিম)”

মাওলানা সাহেব আরও যোগ করলেন,

—“তবে সাবধান! জন্মনিয়ন্ত্রণ স্থায়ীভাবে করলে সেটা আল্লাহর তাকদীরে হস্তক্ষেপ। সাময়িক প্রয়োজনের জন্য শরীয়তসঙ্গত উপায়ে করা যায়, কিন্তু অভাবের ভয়ে নয়।”

সলিম উল্লাহর হৃদয় হালকা হয়ে গেল। তিনি বুঝলেন, ইসলাম মানবকল্যাণ চায়, কষ্ট নয়।

পরদিন সকালে সলিম উল্লাহ ও আলেয়া উঠোনে বসে সকালের আলোয় চা পান করছে। পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে, কারেন্টের একতারে বসে একজোড়া দোয়েল গান গাইছে। আলেয়া সেই দৃশ্য দেখে বলল,

—“দেখো তো হুজুর, পাখিগুলো কেমন নিশ্চিন্তে আছে! তাদের তো কেউ বাজারে পাঠায় না, অথচ প্রতিদিন ওরা খাবার পায়।”

সলিম উল্লাহ হাসল,

—“তুমি ঠিকই বলেছ আলেয়া। রাসুল ﷺ তো বলেছেন,

> ‘যদি তোমরা আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা করতে, তবে তোমাদের রিজিক সেইভাবে দিতেন, যেমন তিনি পাখিদের দেন—তারা সকালবেলা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বের হয়, আর ফিরে আসে পেটভরা হয়ে।’ (তিরমিজি)”

এরপর থেকে আলেয়া ও সলিম উল্লাহ কৃতজ্ঞচিত্তে জীবনযাপন করতে লাগল। যখন আলেয়ার স্বাস্থ্য পুরোপুরি ভালো হয়ে গেল, তখন তাদের ঘরে দ্বিতীয় সন্তান এল—এক কন্যাসন্তান, নাম রাখা হলো “রুকাইয়া।”

কিন্তু এই গল্পের আসল শিক্ষা আসে কয়েক মাস পরের এক রাতে। সেদিন প্রবল বৃষ্টি, বিদ্যুৎ চলে গেছে। আশেপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক। দূরে এক গাছের নিচে সলিম উল্লাহ দেখল, এক কুনোব্যাঙ খোলা মাঠে বৃষ্টিতে আনন্দে লাফাচ্ছে। পাশে এক কুকুর চুপচাপ আশ্রয় নিচ্ছে।

সে মনে মনে বলল,

“আল্লাহর সৃষ্ট সব প্রাণী তাঁরই ব্যবস্থা অনুযায়ী বেঁচে আছে। কেউ কারো রিজিক নিয়ে টানাটানি করে না। শুধু মানুষই করে, কারণ সে বিশ্বাসে দুর্বল হয়ে পড়ে।”

বৃষ্টি শেষে রাতের আকাশে চাঁদ উঠল। মাটিতে জল ঝলমল করছে। সলিম উল্লাহ সেই আলোয় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“হে আল্লাহ, তুমি রিজিকদাতা, তুমি আমাদের যথেষ্ট দাও। আমাদের হৃদয়ে তোমার ওপর পূর্ণ ভরসা দাও।”

তারপর সে আলেয়াকে বলল,

—“দেখো, জীবনটা যত কঠিনই হোক, আল্লাহর দেওয়া সন্তানেরা আসলে রহমত। তাদের রিজিক নিয়ে ভয় পাওয়া মানে আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস।”

আলেয়া বলল,

—“আজ বুঝলাম, আমি ভুল ভাবছিলাম। শরীর দুর্বল থাকলে কিছু সময় বিরতি নেওয়া যায়, কিন্তু অভাবের ভয়ে সন্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ঠিক নয়।”

তাদের এই উপলব্ধি শুধু তাদের ঘরেই নয়, পুরো গ্রামেও আলো ছড়াল। আলেয়া অন্য নারীদেরও বলত,

—“বোনেরা, আমরা মানুষ, আল্লাহ আমাদের অভিভাবক। সন্তান হলে ভয় নয়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। যদি শরীর দুর্বল হয়, চিকিৎসকের পরামর্শে কিছুদিন বিরতি নিতে পারো—কিন্তু অভাবের ভয়ে কখনো না।”

এরপর তাদের সংসারে সুখ নেমে এলো। রাশেদ মাদরাসায় ভর্তি হলো, রুকাইয়া পড়াশোনায় ভালো করল। সলিম উল্লাহর ছোট খেতেও আশীর্বাদ এল।

গ্রামের লোকেরা বলত,

—“সলিম উল্লাহ সাহেবের ঘরে যেন বরকত নেমেছে!”

সলিম উল্লাহ উত্তর দিতেন,

—“বরকত তো আল্লাহর দেওয়া, ভাই। যে তাঁর ওপর ভরসা করে, তাঁর জন্য পথ খুলে দেন।”

🍌 শিক্ষণীয় বার্তা

✓রিজিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা।

মানুষ যত হিসাব করুক, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না।

✓ দারিদ্র্যের ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ হারাম।

এটা আল্লাহর তাকদীরে অবিশ্বাসের শামিল।

✓ তবে শরীরিক দুর্বলতা, অসুস্থতা বা শিশুর ক্ষতির আশঙ্কায় সাময়িক জন্মনিয়ন্ত্রণ জায়েয।

✓কিন্তু স্থায়ীভাবে গর্ভনিরোধ বা সন্তানহীনতার প্রচেষ্টা অনুমোদিত নয়।