🖋️ মজার গল্প: বংশের দেমাগ : এক পতনের আখ্যান।

শীত শেষ হয়ে সবেমাত্র বসন্তের আগমন ঘটেছে। মৃগাঙ্কমণি গ্রামের সকালটি যেন এক শিল্পী তুলিতে আঁকা ছবি। শিশিরভেজা সবুজ ঘাস, তার ওপর ভোরের সোনালী রোদ পড়ে হীরার মতো ঝিকমিক করছে। গ্রামের বুক চিরে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী এখন ভরা যৌবন, তার দু’কূলে কাশফুলেরা যেন সাদা পালকের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। দূরে, রাজমহল পাহাড়ের চূড়ায় কুয়াশার চাদর এখনো পুরোপুরি কাটেনি, তবে তার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে গাঢ় নীল আকাশ। বাতাসের প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে আছে সদ্য ফোটা বুনো শিউলি আর কামিনী ফুলের মিষ্টি সুবাস। এই গ্রামেরই এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে "আলিফ-লায়লা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ"-এর সুবিশাল অফিস ভবন।

এই অফিসের দুইজন কর্মচারী—একজন ইব্রাহিম চৌধুরী, অন্যজন ফোরকান আলী।

ইব্রাহিম চৌধুরী, বয়সে কিছুটা সিনিয়র হলেও, তাঁর পরিচয় কেবল বয়সে নয়—তাঁর ঠাঁট-বাট, পারিবারিক ঐতিহ্য আর বিত্তের দেমাক। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন এক অদৃশ্য অহংকার ঝরে পড়ে। অন্যদিকে, ফোরকান আলী সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া এক তরুণ, মেধা আর পরিশ্রমই তার একমাত্র পুঁজি। তাদের দুজনের কর্মক্ষেত্রে মিল থাকলেও, তাদের জীবনের ক্যানভাসে ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ফোরকানের চোখে স্বপ্ন, আর ইব্রাহিমের চোখে ছিল কেবলই বিত্তের দ্যুতি।

✍️বসন্তের বাতাস আর সলিল চৌধুরীর প্রস্তাব

বসন্তের বাতাস যেন প্রেমের বার্তা নিয়ে এসেছিল ফোরকানের জীবনে। বিয়ের প্রস্তাবের অভাব ছিল না। অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের মেয়েকে ফোরকানের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য উদগ্রীব। কারণ ফোরকান কেবল সুদর্শনই নয়, সে অসম্ভব কর্তব্যপরায়ণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু ফোরকান যেন কিছুতেই কোনো দিকে মন দিতে পারছিল না। তার চোখ যেন গ্রামের অন্য কোনো সৌন্দর্যের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল।

ঠিক এই সময়, এক বিকেলে ইব্রাহিম চৌধুরীর বাড়িতে এলেন সলিল চৌধুরী। তিনি গ্রামের একজন প্রখ্যাত শিক্ষক এবং অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ। সলিল চৌধুরী তার একমাত্র মেয়ে শিউলি’র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন ইব্রাহিমের কাছে।

শিউলি কেবল রূপে গুণেই নয়, তার বুদ্ধিমত্তা আর শিক্ষাও ছিল নজরকাড়া। ইব্রাহিম চৌধুরী আভিজাত্যের মোড়কে মোড়া এক সোফায় হেলান দিয়ে সলিল চৌধুরীর কথা শুনলেন।

ইব্রাহিম ভ্রু কুঁচকে, একরাশ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বললেন, “সলিল ভাই, আপনি তো আমার ঘরের লোক। আপনার এত সাহস হলো কী করে?”

সলিল চৌধুরী মাথা নিচু করে বললেন, “চৌধুরী সাহেব, আমি... আমি আপনার ছেলের জন্যই শিউলিকে চেয়েছিলাম। মেয়েটি আপনার ঘরের বউ হওয়ার যোগ্য।”

ইব্রাহিম চৌধুরী হাসলেন, তবে সে হাসি ছিল শীতল ও বিদ্রূপাত্মক। “যোগ্যতা! আপনি কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, আপনি কার দরবারে এসেছেন? আমার বংশ মর্যাদা কী? আমার চৌদ্দ পুরুষ জমিদারী করেছে। আর আপনারা? আমি খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, আপনারা দরিদ্র ফ্যামিলির লোক। আপনাদের ঘরে একবেলা ভালো খাবার জোটে তো আরেক বেলা জোটে না। আমরা হলাম উচ্চ বংশীয়, আমাদের ধর্ম উপরের দিকে ওঠা। আমরা কখনো নিচু বংশের পোলাপানদের সাথে বিবাহ দিই না।”

তার কণ্ঠস্বর গ্রামের শীতল বাতাসের মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। “সে যতই আমাদের সামনে আসুক না কেন, প্রয়োজন হলে বিভিন্ন কৌশলে তাকে এই উত্তাবদস্থ পথ থেকে বিরত রাখব। আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে! কখনো নয়! প্রয়োজন হলে তার আর্থিক ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন রাস্তায় আমরা বসে থাকবো, তবুও তার সাথে মেয়ের বিয়ে দিবো না। আমাদের বংশের জাত যাবে!”

সলিল চৌধুরী আর কিছু বললেন না। তিনি কেবল মাথা নিচু করে, অপমান আর দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে ফিরে গেলেন। সেদিন, তিতাস নদীর জলও যেন ইব্রাহিম চৌধুরীর অহংকারের ভারে বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল।

🌺গ্রামের নিস্তব্ধতা ও মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের বার্তা

দিন যায়। মৃগাঙ্কমণি গ্রামের প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। গরমের শেষে আসে বর্ষা। আকাশ বাতাস, নদী নালা, পাহাড়-পর্বত যেন সব নতুন করে সেজে ওঠে। বর্ষার ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে যায়। ঝুম বৃষ্টিতে রাজমহল পাহাড়ের সবুজ আরও গাঢ় হয়, আর পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো নতুন উদ্যমে গর্জন করে নামে তিতাসে। গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধ, আর বৃষ্টির তালে ব্যাঙের ডাক—এ যেন এক স্বর্গীয় সুর।

একদিন, সাপ্তাহিক জলসার আসর বসেছে গ্রামের মাঝখানে বিশাল বটগাছের নিচে। সেই আসরে বক্তৃতা রাখতে এলেন প্রখ্যাত আলেম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মেঘের গর্জনের মতো শান্ত অথচ দৃঢ়।

তিনি মানব জীবনের নশ্বরতা ও অহংকারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলছিলেন। উপস্থিত জনতা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। ইব্রাহিম চৌধুরীও সেখানে ছিলেন, তবে তিনি বসেছিলেন কিছুটা দূরে, নিজের আভিজাত্যের বলয়ে।

মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন, “প্রিয়জনেরা! আমরা কিসের অহংকার করি? এই সম্পদ? এই ক্ষমতা? এই বংশ মর্যাদা? মনে রেখো, যে চাঁদ আলো দেয়, তার বুকেও একদিন গ্রহণ লাগে। যে সূর্য আলোকিত করে, তাকেও একদিন আধারে ছেয়ে যায়। পাহাড়ও একদিন ধ্বসে যায়।”

এরপর তিনি সরাসরি ইব্রাহিম চৌধুরীর দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ শান্ত কিন্তু অগ্নিবর্ষী।

“ইব্রাহিম চৌধুরী, তুমি একদিন তো যাবে জমিনের অতল গহ্বরে। তোমার অহংকার, তোমার পারিবারিক মর্যাদা—সবকিছু সেদিন মিথ্যা হয়ে যাবে। এই সম্পদ আর আভিজাত্য তখন ধূলিকণা মাত্র। তোমার এই অহংকার সেদিন কিসের কারণ হবে জানো? অনাথের আহাজারিতে, দরিদ্রের ক্রন্দন ধ্বনিতে! যখন কোনো দুর্বল মানুষকে তুমি তোমার সম্পদের দাপটে অপমান করো, তখন তার ভেতরের যে গভীর দুঃখ জন্ম নেয়, তা এক অভিশাপ হয়ে তোমার জীবনকে ঘিরে ধরে। কারণ, আল্লামা মজলুম (অসহায় মজলুমের) বদ দোয়াকে কেউ ফিরিয়ে দেয় না।”

উপস্থিত সকলে সেদিন ইব্রাহিম চৌধুরীর দিকে তাকাল। অহংকারী ইব্রাহিম চৌধুরী সেদিন যেন সকলের সামনে এক নিমেষে ছোট হয়ে গেলেন। তিনি মাথা নিচু করলেন, কিন্তু তাঁর মনের গভীরে অহংকারের দেয়াল তখনও অটুট ছিল। তিনি ভাবলেন, "এসব দরিদ্রের মনগড়া কথা, আমার মতো ধনী ব্যক্তিকে এসব স্পর্শ করতে পারবে না।"

🌺নিয়তির চক্র ও ফোরকানের উত্থান

নিয়তির চক্র ঘুরতে থাকে। মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের ভবিষ্যদ্বাণীর ঠিক দুই মাস পর, "আলিফ-লায়লা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ"-এ বিশাল অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এল। ইব্রাহিম চৌধুরী, যিনি ছিলেন কোম্পানির অন্যতম মূল পরিচালক, তাঁর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কোম্পানি বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ল। তাঁর সমস্ত বিনিয়োগ আটকে গেল, পারিবারিক সম্পদ প্রায় সবটাই চলে গেল ব্যাংকের হস্তক্ষেপে। তাঁর অহংকার আর ক্ষমতা এক লহমায় ধুলোয় মিশে গেল।

ঠিক এই সময়, ফোরকান আলীর মেধা ও সততা নজরে এল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার। ফোরকান তার প্রখর বুদ্ধি ও নতুন কৌশলের মাধ্যমে কোম্পানিকে বাঁচাতে এগিয়ে এল। ফোরকানের দেওয়া পরিকল্পনা এবং নিরলস পরিশ্রমে কোম্পানি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল। এক বছরের মধ্যেই ফোরকান আলীর পদোন্নতি হলো—সে এখন কোম্পানির একজন পরিচালক। তার বেতন, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ইব্রাহিম চৌধুরীর পতনের পর আকাশ ছুঁয়েছে।

একদিন ফোরকান আলী সলিল চৌধুরীর বাড়িতে গেল। শিউলিকে তার খুব পছন্দ ছিল। সে সলিল চৌধুরীর সামনে গিয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে বলল, “স্যার, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।”

সলিল চৌধুরী ফোরকানের উত্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি ফোরকানের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে হাসলেন। “ফোরকান, তোমার সততা আর নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মেয়েও তোমাকে ভালোবাসে। তবে আমার মনে একটা সন্দেহ আছে—তুমি কি শিউলিকে ভালোবাসো, নাকি তোমার সফলতার মোড়কে আমার পরিবারের মর্যাদা বাড়াতে চাও?”

ফোরকান আলী বিনয়ের সাথে উত্তর দিল, “স্যার, আমি যখন সামান্য কর্মচারী ছিলাম, তখনও শিউলিকে ভালোবেসেছি। আর আমি আপনাকে জানাতে চাই, আপনার দরিদ্রতা কোনোদিনই আমার চোখে বাধা হয়নি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, একজন মানুষ তার বংশ বা সম্পদ দিয়ে নয়, বরং তার চরিত্র ও কর্ম দিয়ে উঁচু হয়। আমাদের ধর্ম উপরের দিকে ওঠা, কিন্তু সেই ওঠা যেন হয় সততা আর বিনয়ের সিঁড়ি বেয়ে, অহংকারের প্রাচীর তুলে নয়।”

🖋️শেষ দৃশ্য: নিয়তির বিচার

ফোরকান ও শিউলির বিয়েতে পুরো গ্রাম আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠল। এই বিয়ে যেন ছিল এক নতুন যুগের সূচনা—যেখানে বংশ নয়, মানুষ তার গুণেই সম্মানিত হয়।

অন্যদিকে, ইব্রাহিম চৌধুরী তখন অফিসের সাধারণ এক কেরানি পদে কাজ করছেন, যেখানে তার একসময়ের অধীনস্থ ফোরকান এখন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। একদিন অফিসে কাজের ফাঁকে ফোরকানের চেম্বারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন ইব্রাহিম চৌধুরী। ফোরকান তাকে দেখে ডাকল।

ফোরকান বিনয়ের সাথে ইব্রাহিম চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলল, “চৌধুরী সাহেব, আমি জানি আপনার জীবনের এই পরিস্থিতি কঠিন। তবে জীবনে চলার পথে অহংকার আর সম্পদ দিয়ে মানুষকে বিচার করা ঠিক নয়। আপনার এক সময়ের কথা মনে আছে? আপনি বলেছিলেন, ‘আমরা হলাম উচ্চ বংশীয়, আমাদের ধর্ম উপরের দিকে ওঠা, আমরা কখনো নিচের দিকে যাব না।’”

ইব্রাহিম চৌধুরী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চোখ দিয়ে অনুতাপের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি নীরবতা ভাঙলেন না।

ফোরকান আলী হাসলেন, সেই হাসি করুণার, কিন্তু বিদ্রূপের নয়। তিনি বললেন, “চৌধুরী সাহেব, মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের কথা মনে রাখবেন, ‘অহংকার আর পারিবারিক মর্যাদা অনাথের আহাজারিতে, দরিদ্রের ক্রন্দন ধ্বনিতে’ একদিন ঠিকই ধ্বসে যায়। আমার বিশ্বাস, এই কষ্টের পথ দিয়ে হেঁটে আপনি একদিন অহংকারের খোলস ছেড়ে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবেন। আপনার জন্য শুভ কামনা।”

ইব্রাহিম চৌধুরী আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, নিয়তি তার বিচার সম্পন্ন করেছে। যে জমিনের অতল গহ্বরে যাওয়ার কথা মাওলানা বলেছিলেন, ইব্রাহিম চৌধুরী সেই মানসিক অতল গহ্বরেই পৌঁছে গেছেন—যেখানে তার অহংকার টুকরো টুকরো হয়ে মিশে গেছে অনুতাপের মাটিতে। তিনি এখন জানেন, মানুষের আসল মর্যাদা সম্পদের প্রাচীরে নয়, বিনয় ও ভালোবাসার শক্তিতে।

🍌রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম

আরবি প্রভাষক বলদীআটা ফাজিল মাদ্রাসা ধনবাড়ী টাঙ্গাইল জেলা।

Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL Islam.