উপন্যাস:“হিংসার আগুনে পুড়ে যাওয়া
💐রচনায় মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
🪶প্রভাষক হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা,মান্দা নওগাঁ।
রচনার তারিখ:১১/১১/২০২৩
প্রথম পর্ব: সমাজের মুখোশ ও জন্মের গল্প
অনেক অনেক দিন আগের কথা।
তখনকার বাংলাদেশ ছিল এখনকার মতো শহরনির্ভর নয়।
দেশজুড়ে নদী, খাল, বিল, ঝোপঝাড়, পাখির কলতান—সবকিছুই ছিল প্রাণবন্ত অথচ সরল এক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
মানুষ ছিল সাদাসিধে, কিন্তু সমাজ ছিল জটিল।
মানুষের পোশাক ছিল পরিচ্ছন্ন, কিন্তু চিন্তা ছিল কলুষিত।
সময়টা ছিল মধ্যযুগের এক অংশ, আনুমানিক নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক।
তখন গৃহস্থ বাড়িগুলোতে ছিল চাকর-বাকরের ভিড়।
ধনীর বাড়ির বৌ-ঝিরা নিজেদের আভিজাত্যে বাসত, আর গরিবের মেয়েরা ঘর-সংসারের কাজ করে জীবন কাটাত।
তখনকার সমাজে মেয়েদের বয়স পনেরো-ষোলো পেরোলেই বিয়ের ব্যবস্থা করা হতো।
কারণ গ্রামের প্রবাদের মতো কথা ছিল,
“মেয়ের বয়স বাড়লে মান-সম্মান কমে।”
মধ্যযুগের ছেলেরা এই ধরনের গান গেয়ে বেড়াতো-
“ষোড়শী নারীর রূপের বাহার মুগ্ধ করে মন
মন ছুটে যায় বারে বার করি আলিঙ্গন।’
জানি নানিরা আগে বলতো –
মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি।
যুগ পালটেছে
কিন্তু পাল্টাইনি সমাজের চিত্র আনাচে-কানাচে অসভ্যতা আর বেহায়াপনার সয়লাবে বেঁচে গেছে দেশ।
গরিবের ঘরের মেয়েরা জানত, তাদের জীবনে নিজের সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই।
পিতা-মাতা যাকে বলবে, তাকেই বিয়ে করতে হবে।
আর যেদিন বিয়ে হবে, সেদিনই যেন জীবনের স্বাধীনতা কবর দেওয়া হবে।
কিন্তু ধনীদের বাড়িতে সেই একই নিয়ম ভিন্নভাবে চলত।
ধনীর মেয়ে যদি কোন চাকরের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে বা অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে যায়, তখন সেটা “প্রেম” নামে খ্যাত হতো।
মানুষ বলত,
> “ধনীর মেয়ে তো প্রেম করেছে, আহা! মন বোঝে না জাত-পাত।”
কিন্তু গরিবের মেয়ে যদি ভালোবেসে বিয়ে করে, তখন সমাজ তার গায়ে লেপে দিত লজ্জার কালি।
গ্রামের মুরুব্বিরা হাসতে হাসতে বলত—
> “ধনীর মেয়ে বেরিয়ে গেলে অপরাধ তা নয়,
গরিবের মেয়ে হাত ধরিলে সমাজ মন্দ কয়।”
এই বৈষম্যের সমাজেই জন্ম নিলো এক মেধাবী ও স্বপ্নদর্শী তরুণ—অনুপম চৌধুরী।
তার পিতা ছিলেন গ্রামের এক সময়কার নামকরা শিক্ষক।
তিনিই প্রথম ছেলেকে শিখিয়েছিলেন—“মানুষ বড় হয় জ্ঞান ও ন্যায়ে, জন্ম ও ধনে নয়।”
অনুপমের মধ্যে ছিল এক অদম্য আগ্রহ, সমাজকে বদলানোর তীব্র ইচ্ছা।
সে চাইত—একটা এমন সমাজ, যেখানে গরিবের সন্তানও সম্মান পাবে, মেয়েরা নিজের মর্যাদায় বাঁচতে পারবে, হিংসা আর অহংকারের বিষ কমে যাবে।
গ্রামটিতে তখন আরেকজন তরুণও ছিল—চনতু খাঁ।
সে ছিল গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবারের সন্তান।
চনতুর পিতা ছিলেন জমিদার প্রায়, প্রজাদের ওপর তাঁর ছিল অদ্ভুত প্রভাব ও কর্তৃত্ব।
শিশু বয়স থেকেই চনতু শিখেছিল—“আমি ধনী, আমি শক্তিশালী, সবাই আমার নিচে।”
ফলে তার মন ভরে উঠেছিল অহংকার, দম্ভ আর হিংসায়।
যখনই সে দেখত কেউ তার চেয়ে ভালো করছে, তখনই তার বুকের ভেতর আগুন জ্বলত।
সে ভাবত—
> “ওরা আমাকে ছাড়িয়ে যাবে? অসম্ভব! আমি ধনীর ছেলে, আমার আগে কেউ যেতে পারে না।”
এই হিংসা ছিল তার জীবনের স্থায়ী ছায়া।
অনুপম পড়াশোনায় ভালো করায় চনতুর মনে ঈর্ষা জন্মায়।
শিক্ষকেরা অনুপমকে প্রশংসা করলেই চনতুর মুখ লাল হয়ে যেত।
এদিকে সমাজজুড়ে তখন চলছিল অন্যায়ের রাজত্ব—
চাঁদাবাজি, জোর করে জমি দখল, ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ ,মেয়েদের বিয়েতে মোটা দেনমোহর, আর হিংসার আগুনে পোড়া মানুষের কান্না।
এই অন্ধকার সময়েই গ্রামে প্রবেশ করলেন এক তরুণ আলেম—মাওলানা ফরিদ উদ্দিন।
তিনি ছিলেন জ্ঞানী, বিনয়ী ও মানবপ্রেমিক।
গ্রামে প্রথম দিনেই তিনি মানুষদের জড়ো করে বলেছিলেন—
> “ভাইয়েরা, সমাজ তখনই সুন্দর হয়, যখন হিংসা ও অহংকারের স্থান থাকে না।
🖋️আল্লাহ বলেন,
“অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট।”
সূরা নাহল -২৯
তিনি আরো বুঝালেন
“আল্লাহ অহংকারী ও দাম্বিকদেরকে কখনো ভালোবাসেন না।”
গ্রামের লোকেরা তখনও এমন খুতবা শুনতে অভ্যস্ত ছিল না।
তারা অবাক হয়ে শুনল।
কেউ কেউ ভাবল, “এই তরুণ আলেম বুঝি সমাজে ঝড় তুলবে।”
চনতু খাঁর মনে তখন থেকেই জ্বলে উঠল নতুন এক আগুন।
সে ভাবল,
> “এই ফরিদ উদ্দিন যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে আমাদের পরিবারের সম্মান কোথায় যাবে?”
অন্যদিকে অনুপম চৌধুরী ,ফরিদ উদ্দিনের কাছ থেকে প্রেরণা পেতে লাগল।
সে বুঝল, সমাজ বদলাতে চাইলে প্রথমে মানুষকে চিন্তার দিক থেকে বদলাতে হবে।
এভাবেই ধীরে ধীরে অনুপম ও ফরিদ উদ্দিন একসাথে গ্রামের তরুণদের শিক্ষা দিতে শুরু করলেন।
তারা মসজিদে কুরআনের ক্লাস চালু করলেন, গ্রামে একটি ছোট মক্তব স্থাপন করলেন।
গ্রামের গরিব মানুষ তাদের পাশে দাঁড়াল।
কিন্তু ধনীদের মন পুড়ে গেল।
কারণ গরিবরা সচেতন হলে, ধনীরা আর শোষণ করতে পারবে না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে একদিন ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা—
ধনী মহিষুর চৌধুরীর মেয়ে রত্না চৌধুরী তার বাড়ির চাকর মকবুল-এর সঙ্গে পালিয়ে গেল।
এ যেন বজ্রপাত!
পুরো গ্রাম কেঁপে উঠল।
কেউ কেউ বলল, “প্রেমের জয় হয়েছে।”
আবার কেউ বলল, “ধনীদের লজ্জা নেই!”
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই লোকেরা তা ভুলে গেল।
ধনীর মেয়ে পালিয়েছে—এটা হাসির বিষয় নয়, বরং “রোমান্টিক” গল্পে পরিণত হলো।
ঠিক এই সময়েই পাশের পাড়ায় ঘটে গেল আরেক ঘটনা—
এক গরিব কৃষকের মেয়ে রেশমা তার প্রিয় মানুষ সফিকুল-এর সঙ্গে বিয়ে করে ফেলল, পারিবারিক সম্মতি ছাড়াই।
এবার সমাজ যেন আগুন হয়ে উঠল।
রেশমাকে গ্রামের লোকেরা অপমান করল, তার পরিবারকে নির্বাসিত করার মতো করে তুলল।
মসজিদে মসজিদে তার নাম ধরে আলোচনা চলল।
এই অন্যায় দেখে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন একদিন জুমার খুতবায় বললেন—
> “মানুষের মর্যাদা তার কাজ ও চরিত্রে, ধনসম্পদে নয়।
তিনি আরো বলেন, ‘‘আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা সম্পদ দেখবেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও আমল দেখবেন।’’
তার এই কথাগুলো সমাজের মানুষের মাঝে নানাভাবে প্রতিফলিত হতে লাগলো।
তিনি আরো বললেন “মেয়েদেরকে উপযুক্ত বয়সে বিয়ে না দিলে তারা যদি কোন অপকর্ম করে বসে তাহলে এই পাপের শাস্তির অংশ তার অভিভাবককেও বহন করতে হবে।”
যদিও যে অপরাধ করবে তার শাস্তি অবশ্যই সে ভোগ করবে।
এবং তিনি আরো বললেন আমাদের সমাজে পার্কে রিসোর্টে আবাসিক হোটেলে যে অপকর্মগুলো ঘটছে তা সন্তানদের উপযুক্ত বয়সে বিবাহ না দেওয়ার কারণেই ঘটছে।
তিনি আরও বললেন,
> “হিংসা, অহংকার আর অন্যায়—এগুলো সমাজকে ধ্বংস করে।
শয়তানও হিংসার কারণে অভিশপ্ত হয়েছে।
সে বলেছিল—‘আমি তার চেয়ে উত্তম, তুমি আমাকে আগুন দিয়ে আর তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছ।’ (সূরা আল-আ’রাফ: ১২)”
গ্রামের মানুষ তখন চুপ করে গেল।
কিন্তু চনতু খাঁর বুকের ভেতর তখন রক্ত উথলে উঠছে।
সে অনুভব করল, মাওলানা ফরিদ যেন সরাসরি তাকেই লক্ষ্য করে কথা বলছে।
এবার তিনি আরো বললেন আমাদের সমাজের একটি চিত্র হলো যখন মানুষেরা নীতি-নৈতিকতা হারায় তখন অন্ধকার গলিতে তারা প্রবেশ করে কুকাম আকাম করে।
তারপর থেকে চনতুর মুখোশ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল।
সে গোপনে ষড়যন্ত্র শুরু করল—অনুপম আর ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
এভাবেই শুরু হলো এক অন্ধকার অধ্যায়—যা দ্বিতীয় পর্বে রূপ নেবে হিংসা, প্রেম ও প্রতিশোধের গল্পে…
চমৎকার ভাবে।
🍌 দ্বিতীয় পর্ব: হিংসা, প্রেম ও দ্বন্দ্বের আগুন
রেশমা ও সফিকুলের বিয়ের ঘটনায় গ্রামজুড়ে ঝড় বয়ে গেল।
ধনীরা ক্ষেপে গেল, গরিবেরা চুপসে গেল।
চনতু খাঁর পিতা বললেন—
> “এই মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আর ওই অনুপম চৌধুরী গ্রামের ছেলেদের মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
এইসব মানুষদের থামাতে হবে, নইলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়াবে।”
চনতু খাঁ হেসে উত্তর দিল—
> “বাবা, চিন্তা করবেন না। আমি এমন ব্যবস্থা করব, যাতে ওরা নিজেরাই সমাজ থেকে মুছে যায়।”
এইভাবেই শুরু হলো হিংসার জাল বোনা।
💐 সমাজের ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া
চনতু খাঁ শুরু করল অপপ্রচার।
সে বলল, “অনুপম নাকি গরিবদের উসকে দিচ্ছে ধনীদের বিরুদ্ধে।”
কেউ কেউ বিশ্বাস করল, কেউ সন্দেহ করল।
কিন্তু চনতু থামল না।
একদিন সে আরেকটা গুজব ছড়াল—
> “অনুপম চৌধুরী নাকি মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের সাহায্যে রেশমা ও সফিকুলকে পালাতে সাহায্য করেছে।”
এই কথাটি গ্রামের বড়দের কানে যেতেই মসজিদের বারান্দায় গর্জে উঠল বৈঠক।
বৃদ্ধ মুরুব্বি হাশেম আলী বলল,
> “এই দুইজন তরুণ সমাজ নষ্ট করছে। ধর্মের কথা বলে নিজেরা অন্যায় করে।”
অনুপম এসব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।
সে ভাবল, “আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। শুধু চেয়েছিলাম, মানুষ যেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে।”
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—
> “বেটা অনুপম, আল্লাহর পথে যারা কাজ করে, তারা কষ্ট পায়—এটাই সুন্নাহ। নবীগণও তো এভাবেই কষ্ট সহ্য করেছেন। ধৈর্য ধরো।”
কিন্তু চনতুর ষড়যন্ত্র এখানেই থেমে রইল না।
💐 প্রেমের ছোঁয়া ও নতুন উত্তেজনা
এদিকে মহিষুর চৌধুরীর মেয়ে রত্না, যে মকবুলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, কয়েক মাস পর ফিরে এল।
গ্রামজুড়ে তখন নতুন গুজব—“মকবুল নাকি শহরে মারা গেছে, রত্না এখন বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছে।”
মহেশ্বর চৌধুরী লজ্জায় কারও সামনে মুখ দেখাতে পারছিলেন না।
এই সুযোগে চনতু খাঁর পরিবার মহেশ্বর চৌধুরীর সঙ্গে জোট বাঁধল।
তারা বলল,
“আমরা রত্নার জন্য ভালো সমাধান জানি। অনুপম চৌধুরীর মতো একটা ‘ভদ্র’ ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে দিলে লজ্জা ঢাকা পড়ে যাবে।”
মহিষুর চৌধুরী রাজি হলেন।
কিন্তু কেউ অনুপমের মতামত জানতে চাইল না।
গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ল—“অনুপমের সঙ্গে রত্নার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
অনুপম হতভম্ব হয়ে গেল।
সে কখনও কল্পনাও করেনি ধনী ঘরের মেয়ে তাকে বেছে নেবে।
আর সমাজের চোখে এটা ছিল অসম বিয়ে—গরিব ছেলে, ধনী মেয়ে।
চনতুর মুখে তখন ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি।
সে নিজের মনে বলল,
“এই বিয়েই হবে আমার প্রতিশোধের হাতিয়ার।”
🍯গুজবের আগুন
চনতু গোপনে আরও মিথ্যা ছড়াতে লাগল—
“অনুপম তো রত্নার সঙ্গে আগে থেকেই সম্পর্ক রাখত, তাই মকবুলের পালানোর পেছনেও ওর হাত ছিল।”
এমন কথা শুনে গ্রামের মানুষদের চোখ-মুখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল।
ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে সন্দেহ জন্ম নিল, যেন অনুপম কোনো অশ্লীল খেলায় জড়িত।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন বিষয়টা শুনে খুব কষ্ট পেলেন।
তিনি অনুপমকে ডেকে বললেন—
“বেটা, সমাজের দোষীদের মুখ বন্ধ করা কঠিন। কিন্তু তুমি সত্যের পথে থাকো, আল্লাহ তোমার সহায় হবেন।”
“আল্লাহ বলেন,’ ‘সত্যের পক্ষে দাঁড়াও, যদিও তা তোমার নিজের বিরুদ্ধে যায়।’’
(সূরা আন-নিসা: ১৩৫)”
অনুপম বলল, “হুজুর, আমি আর সমাজে থাকতে চাই না। মানুষ আমার ভালো বুঝে না।”
মাওলানা তাকে বুঝিয়ে বললেন—
“যে সমাজকে বদলাতে চায়, তাকে কষ্ট ভোগ করতে হয়। নবী ইউসুফ (আঃ)-কেও তো মিথ্যা অপবাদে কারাগারে যেতে হয়েছিল, কিন্তু শেষে আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন।”
এই কথাগুলো অনুপমের হৃদয়ে শক্তি জোগাল।
সে স্থির করল, যত অন্যায়ই হোক, সে সত্যের পক্ষে থাকবে।
🍌সংঘর্ষের সূচনা
এক রাতে চনতু খাঁ ও তার কয়েকজন অনুসারী গোপনে অনুপমের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল।
বাড়ির অর্ধেক পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
তবে আল্লাহর কৃপায় কেউ মারা গেল না।
পরদিন সকালেই পুরো গ্রাম ঘটনাস্থলে ভিড় জমাল।
চনতু কাঁধে চাদর জড়িয়ে এসে বলল,
> “দেখো, আল্লাহর গজব! যে সমাজে অন্যায় করে, তার ঘর এভাবেই জ্বলে যায়।”
মানুষ চুপ করে রইল।
কেউ কেউ সন্দেহ করল, কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছু বলতে পারল না।
অনুপম তখন চুপচাপ বসে ছিল পুড়ে যাওয়া ঘরের পাশে।
তার চোখে জল নয়—বরং এক ধরনের দৃঢ়তা।
সে বলল,
> “যদি মানুষ মিথ্যা বলে, আল্লাহ সত্য প্রকাশ করবেন। আমি আমার বিশ্বাস হারাব না।”
সেই দিন সন্ধ্যায় মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মসজিদে দাঁড়িয়ে বললেন—
> “ভাইয়েরা, আল্লাহ বলেন, ‘হিংসা ও বিদ্বেষে একে অপরকে ধ্বংস করো না।’ (সূরা আল-হুজুরাত: ১১)
যে অন্যের ক্ষতি চায়, আল্লাহ তার নিজের ঘর ধ্বংস করেন।”
এই কথাগুলো চনতুর কানে পৌঁছাল।
সে রাগে কাঁপতে লাগল।
তার মনে হলো, ফরিদ উদ্দিন যেন তাকে প্রকাশ্যে অপমান করছে।
সে সিদ্ধান্ত নিল—এবার শেষ খেলা খেলতে হবে।
সে ভাবল,
> “অনুপমের জীবনে এমন আঘাত দেব, যাতে সে আজীবন সমাজ থেকে মুছে যায়।”
চনতুর এই সিদ্ধান্তই গ্রামে ঘটাতে চলেছে এমন এক ঘটনা, যার পরিণতিতে সে নিজেই হারাবে সব—
মান, পরিবার, এমনকি নিজের মনুষ্যত্বও।
এভাবেই গ্রামে হিংসা ও প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে পড়ল—
যেখানে ভালোবাসা পুড়ল, সততা দগ্ধ হলো, আর মানুষ হারাল তার মানবিকতা।
পরবর্তী: তৃতীয় পর্ব —
“অনুশোচনা, পরিবর্তন ও সমাজের জাগরণ”
🌺 তৃতীয় পর্ব: অনুশোচনা, পরিবর্তন ও সমাজের জাগরণ
চনতু খাঁর হিংসা তখন বিষে পরিণত হয়েছে।
তার চোখে অনুপম যেন শত্রু, আর মাওলানা ফরিদ উদ্দিন যেন সেই শত্রুর প্রেরণাদাতা।
প্রতিশোধের আগুনে সে নিজেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা বুঝতে পারছে না।
🍌ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পর্ব
এক রাতে চনতু তার চেলা শিবলু আর মকছুদের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করল।
সে বলল,
> “আমরা এমন কিছু করব যাতে অনুপম ও মাওলানাকে চিরদিনের মতো গ্রাম থেকে তাড়ানো যায়।
কাল সকালে মহিষুর চৌধুরীর বাড়িতে রত্নার নাম ভাঙিয়ে একটা নাটক সাজাও। বলবে—অনুপম নাকি রত্নাকে রাতে দেখতে গিয়েছিল!”
পরদিন সকালে গুজবের আগুন আবার ছড়িয়ে পড়ল—
“রাতে কেউ নাকি রত্নার ঘরে ঢুকেছিল! মহিষুর চৌধুরীর লোকেরা ধরতে পারেনি, কিন্তু সন্দেহ করছে অনুপমকে।”
গ্রামের মানুষ আবার চঞ্চল হয়ে উঠল।
সকালে মসজিদের সামনের পুকুরপাড়ে বড় বৈঠক ডাকল গ্রামের মুরুব্বিরা।
সেখানে সবাই দাঁড়িয়ে একবাক্যে বলল,
> “এটা যদি সত্য হয়, অনুপমকে গ্রাম থেকে বের করে দিতে হবে!”
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন ঘটনাস্থলে এসে বললেন,
> “তোমরা কারও প্রতি সন্দেহ করতে পারো না প্রমাণ ছাড়া। ইসলাম শেখায়—‘যদি কোন সংবাদ তোমাদের কাছে আসে, তা যাচাই করো।’ (সূরা আল-হুজুরাত: ৬)”
কাউকে সন্দেহের বসে ফাসিয়ে দেওয়া চরম গাদ্দারী অন্যায়।
মিথ্যা অপবাদ দেওয়া চরম অন্যায় শরীয়তে ৮০ বেত্রাঘাতের কথা উল্লেখ আছে।
কিন্তু উত্তেজিত জনতা তখন যুক্তির কথা শুনতে রাজি নয়।
অনুপম নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে কাঁপতে লাগল।
চনতু তখন জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
> “আমি নিজের চোখে দেখেছি অনুপমকে রত্নার ঘরের পাশে ঘুরতে!”
সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
এক মুহূর্তেই মানুষ বিশ্বাস করে ফেলল মিথ্যাকে।
অনুপম মাটিতে বসে পড়ল। চোখে জল চলে এল।
সে বলল,
“আল্লাহ আমার সাক্ষী। আমি নির্দোষ।”
কিন্তু কে শুনবে তার কথা?
সমাজের বিচার কখনও কখনও আল্লাহর বিচারের ঠিক বিপরীত হয়।
সেদিন বিকেলে অনুপম সিদ্ধান্ত নিল—
সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে, যতদিন না সত্য প্রকাশ পায়।
চলে যাওয়ার আগে মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের কাছে এসে বলল,
“হুজুর, আমি সত্য জানি, কিন্তু মানুষ শুনতে চায় না। মনে হয় আমি ব্যর্থ।”
মাওলানা তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“তুমি ব্যর্থ নও, বেটা। কষ্টের পরেই সাফল্য আসে।
আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে আছে স্বস্তি।’ (সূরা ইনশিরাহ: ৬)”
এই কথা শুনে অনুপম নীরবে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল শহরের দিকে।
গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে বিষয়টি ভুলে গেল, কিন্তু চনতুর অন্তরে হিংসার শিখা আরও জ্বলতে লাগল।
💐গজবের প্রথম আঘাত
এক মাস পর মহিষুর চৌধুরীর বাড়িতে বজ্রপাত হলো।
রত্না গভীর অসুস্থ হয়ে পড়ল।
চিকিৎসা করেও সুস্থ হলো না।
মৃত্যুর আগে সে বলল,
“আমি নির্দোষ। যেদিন রাতে গুজব ছড়াল, সেদিন আমি অসুস্থ ছিলাম। কেউ ঘরে আসেনি।
আমাকে মিথ্যা অপবাদে ব্যবহার করা হয়েছে।”
এই কথাগুলো শুনে মহিষুর চৌধুরী কেঁপে উঠলেন।
তিনি বুঝলেন, কারও ষড়যন্ত্রে অনুপমের জীবন ধ্বংস হয়েছে।
কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সেই রাতেই গ্রামের এক ছেলেকে ধরে আনে মহিষুর চৌধুরীর লোকেরা—সে ছিল চনতুর চেলা শিবলু।
প্রশ্নের মুখে শিবলু কেঁদে ফেলল।
সব খুলে বলল—“চনতু খাঁ-ই বলেছিল গুজব ছড়াতে।”
এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রাম যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।
মানুষ বুঝল, এতদিন তারা হিংসা ও মিথ্যার ফাঁদে বন্দি ছিল।
চনতু খাঁ তখন নিজের বাড়িতে।
লোকজন এসে তাকে ঘিরে ফেলল।
কেউ গালাগালি দিল, কেউ থুথু ফেলল।
চনতু তখন ভয় আর লজ্জায় কাঁপছে।
তার চোখ থেকে জল পড়ছে, সে বারবার বলছে—
“আমি ভুল করেছি, আমি হিংসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম!”
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন তার দিকে এগিয়ে গেলেন।
সবাই ভাবল, এখন নিশ্চয় তিনি তাকে অভিশাপ দেবেন।
কিন্তু না—
মাওলানা শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“চনতু, তুমি অন্যায় করেছো, কিন্তু যদি আন্তরিক তওবা করো, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন।
তবে মনে রেখো “মজলুমের বদ দোয়া আল্লাহ্ ফেরত দেন না।”
কারণ আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।”
’ (সূরা আয-জুমার: ৫৩)”
চনতু হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগল।
তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারা বইছে।
সে বলল,
> “হুজুর, আমি অন্যায় করেছি, আমার হিংসা আমাকে ধ্বংস করেছে।
আমার মেয়েকে যেন কেউ কখনো আমার মতো না দেখে।” হুজুর বললেন মেয়েকে আদর্শ শিক্ষা দিয়ে ভাল পাত্রে পাত্রস্থ করতে পারলে জান্নাতের অংশীদার হতে পারবেন এই কথাগুলো যেন চনতু সাহেবের মনে আচর কাটলো।
🪷অনুতাপ ও পরিবর্তন
চনতু এরপর থেকে বদলে গেল।
সে অনুপমের বাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত অংশ নিজেই মেরামত করল, রেশমার পরিবারের জন্য সাহায্য পাঠাল, আর গরিবদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ শুরু করল।
মানুষ প্রথমে বিশ্বাস করেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝল—সে সত্যিই পরিবর্তিত হয়েছে।
অন্যদিকে শহরে থাকা অনুপমও খবর পেল গ্রামের ঘটনার।
সে ফিরে এল, কিন্তু মুখে কোনও তিক্ততা নেই।
সে চুপচাপ চনতুর বাড়িতে গেল।
দেখল, একসময়ের অহংকারী সেই তরুণ আজ মসজিদের সামনে বসে কান্না করছে।
অনুপম বলল,
> “ভাই চনতু, তুমি কেঁদো না। আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি।
আমি জানি, হিংসা মানুষকে অন্ধ করে ফেলে।”
চনতু মাথা তুলে তাকাল।
দুই তরুণের চোখে তখন একই অশ্রু, কিন্তু ভেতরে ছিল ভিন্ন অর্থ—
একজনের চোখে করুণা, আরেকজনের চোখে অনুশোচনা।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন এই দৃশ্য দেখে বললেন,
> “দেখো, এটাই ইসলামের সৌন্দর্য—ক্ষমা।
‘যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।আস আমরা সকলে একে অপরকে ক্ষমা করি।
🌹 সমাজের জাগরণ
চনতুর অনুশোচনার পর গ্রামটিতে এক নতুন পরিবর্তন দেখা দিল।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের উদ্যোগে স্থাপিত হলো নতুন একটি বিদ্যালয়—
‘হিংসামুক্ত শিক্ষা নিকেতন’।
এর প্রথম দান দিল চনতু খাঁ নিজেই।
অনুপম সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হলেন।
সেখানে ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম সবাই একসাথে পড়তে লাগল।
পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলো “নৈতিকতা”, “হিংসা থেকে মুক্তির শিক্ষা”, “ইসলামী চরিত্র গঠন”।
প্রতিদিন সকালবেলা অনুপম বলতেন—
> “বাচ্চারা, মনে রেখো, হিংসা কখনো তোমাকে উন্নত করবে না।
কারও ভালো দেখে ঈর্ষা করো না; বরং বলো—‘আল্লাহ, আমাকেও তেমন নেক কাজের তৌফিক দাও।’”
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন নিয়মিত বয়ান করতেন—
“যে সমাজে ক্ষমা, ন্যায় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সমাজেই শান্তি নেমে আসে।”
হিংসা, অহংকার, মিথ্যা—এগুলোই সব অনর্থের মূল।”
বছর ঘুরে গেল।
চনতু খাঁ আজ সমাজের সবচেয়ে বিনয়ী মানুষ।
মানুষ তাকে সম্মান দেয়, কিন্তু সে সবসময় বলে—
“আমি একদিন হিংসার আগুনে অন্যের জীবন পুড়িয়েছিলাম, আল্লাহর রহমতে আজ সেই আগুন নিভে গেছে।”
গ্রামের মসজিদের পাশে এখন একটি ফলক ঝুলছে, যেখানে লেখা—
> “সত্য, ক্ষমা ও হিংসামুক্ত সমাজের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই।”
আর অনুপম চৌধুরী?
সে আজ গ্রামের শিশুদের প্রিয় শিক্ষক।
তার স্বপ্ন এখন বাস্তব—একটি সমাজ, যেখানে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান মর্যাদা।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন তরুন যুবক কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে মক্তবে বসে ছোট ছোট বাচ্চাদের কুরআন পড়ান।
তাঁর চোখে তৃপ্তির আলো।
তিনি একদিন অনুপমকে বললেন,
“দেখো বেটা, আল্লাহর কাজ কখনো বিফল হয় না।
আমরা হয়তো ছোট মানুষ, কিন্তু যদি সত্যের পথে থাকি, আল্লাহ আমাদের মাধ্যমে সমাজে আলো ছড়ান।”
সূর্য ডুবে যায় পশ্চিমে, আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে
।
গ্রামের মসজিদে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে—
> “হাইয়া আলাল ফালাহ…”
(চলো সফলতার পথে…)
সেই ধ্বনির সঙ্গে যেন ভেসে আসে অনুপম, চনতু খাঁ আর ফরিদ উদ্দিনের গল্প—
এক সমাজের, যে সমাজ শিখেছে—
হিংসা ধ্বংস ডেকে আনে, আর ক্ষমাই সত্যিকারের বিজয়।
🖋️শেষ কলমে,
💐মাওলানা মোঃ ফরিদুল ইসলাম
প্রভাষক হাদীস পরানপুর কামিল মাদ্রাসা মান্দা, নওগাঁ।
রচনায় তারিখ:১১/১১/২০২৩
Copyright ©️ All rights reserved by author maulana MD FARIDUL Islam.